[১] দর্শনে প্রকৃতিবাদ তিন ধরনের হতে পারে: সাত্ত্বিক, তান্ত্রিক ও নৈতিক। সাত্ত্বিক প্রকৃতিবাদে অতিপ্রাকৃত কোনকিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না, তান্ত্রিক প্রকৃতিবাদ বলে দার্শনিক পদ্ধতি বা তন্ত্রকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতো হতে হবে, আর নৈতিক প্রকৃতিবাদে দাবি করা হয় বস্তুনিষ্ঠ নৈতিক তথ্য সত্যিই আছে এবং এসব তথ্য প্রাকৃতিক জগতেরই অংশ। প্রাচীন ভারতে তিন ধরনের প্রকৃতিবাদই পাওয়া যায়, তবে একই দর্শনধারা বা সিস্টেম কখনো প্রকৃতিবাদী কখনো অতিপ্রাকৃতবাদী হতে পারে। যেমন অদ্বৈত বেদান্তের সত্ত্ববিদ্যা পুরাপুরি অতিপ্রাকৃত হলেও তত্ত্ববিদ্যা অনেকটাই প্রাকৃতিক। নৈতিক প্রকৃতিবাদ অবশ্য ক্লাসিকেল ইন্ডিয়ান ফিলোসফির প্রায় সব সিস্টেমেই পাওয়া যায়। ক্লাসিকেল বলতে এখানে বৈদিক যুগের শেষ থেকে শুরু করে পনের শতকে প্রাগাধুনিক যুগের সূচনা পর্যন্ত সময়টাকে বুঝানো হচ্ছে। ক্লাসিকেল দর্শনে বেদবাক্য পুরাপুরি বিশ্বাস করা হতো বেদান্ত মীমাংসা সাংখ্য যোগ ন্যায় ও বৈশেষিক এই ছয় ধারায়। আর বেদকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে তৈরি হইছিল চার্বাক বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনধারা। অন্য আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতিবাদকে ‘কঠিন’ ও ‘সহজ’ এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। কঠিন প্রকৃতিবাদীরা মানুষের ব্যক্তিক সবকিছুকেও নিছক প্রাকৃতিক বস্তুর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব বলে মনে করে। আর সহজ প্রকৃতিবাদীরা মনে করে প্রকৃতির ভিতরেই মানুষের ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গির আলাদা জায়গা আছে।
[২] সব প্রকৃতিবাদী একমত যে প্রকৃতির বাইরে কিছু নাই, কিন্তু প্রকৃতি মানে কি, প্রকৃতির সীমানা কোথায়? এইখানে মতভেদ আছে। ভারতে দুইটা এক্সট্রিম পাওয়া যায়। একদিকে বেদান্তীরা মনে করে পুরা বিশ্বই মায়া, অবাস্তব, আমাদের জগৎ একটা সনাতন পরিবর্তনহীন পরম জগতের সাময়িক রূপ মাত্র। আরেক দিকে চার্বাকরা মনে করে আমাদের দেখা বিশ্বের বাইরে কিছু নাই এবং এই বিশ্ব বস্তু দিয়ে তৈরি, চেতনা বস্তুর আবির্ভূত বৈশিষ্ট্য, আত্ম পদার্থ দিয়েই গঠিত। চার্বাকরা নিজেদেরকে স্বভাববাদী বলত, আর স্বভাব ইংলিশ ‘নেচার’ শব্দের আরেক অর্থ। ন্যাচারালিজম বাংলায় প্রকৃতিবাদ ও স্বভাববাদ দুটাই হতে পারে। চার্বাকদের মতে, একটা ইফেক্ট তার কজের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে তার স্বভাবের উপর। একটা জিনিস এমন কারণ তার স্বভাবই এমন, স্বভাব ছাড়া অন্য কোনো বাহ্যিক কজ তাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে না। সুতরাং মোটা দাগে অদ্বৈত-বেদান্তীদেরকে অপ্রকৃতিবাদী আর চার্বাকদের প্রকৃতিবাদী বলা যায়। এই দুই চরমের মাঝে আছে বৌদ্ধ জৈন ন্যায়-বৈশেষিক আর সাংখ্য-যোগ দর্শন। এদের মধ্যে কোনটা কোন দিকে বেশি ঝোঁকা তা বুঝতে হলে দেখতে হবে দুইটা প্রশ্নের উত্তর কে কিভাবে দেয়: বিশ্ব কি দিয়ে তৈরি, এবং নিমিত্ত (কজেশন) কিভাবে কাজ করে? কারণ বিশ্বের গাঠনিক উপাদান আর উপাদানগুলার মধ্যে নৈমিত্তিক সম্বন্ধ বুঝলেই প্রকৃতি বুঝা যায়।
[৩] প্রকৃতি বা বিশ্ব কি দিয়ে গঠিত এই প্রশ্নের উত্তর এখানে খোঁজা হয়। ভারতে দুই ধরনের উত্তর পাওয়া যায়। এক দল মনে করে বিশ্বের সবকিছু পরমাণু দিয়ে গঠিত। পরমাণুবাদী দর্শন হলো ন্যায়-বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈন। আরেক দল মনে করে প্রকৃতি একটা চিরচঞ্চল ‘মূলপ্রকৃতি’র রূপান্তর। সাংখ্য-যোগ দর্শন মূলবাদী। তবে অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাসী বেদান্তীরাও অনেক সময় মূলপ্রকৃতির মতো কিছু একটার কথা বলে।
[৪] গ্রিক এটমের সাথে ভারতীয় পরমাণুর অনেক মিল আছে। ভারতে পরমাণুবাদ শুরু হইছে উপনিষদের পঞ্চভূত বা পাঁচ উপাদান দিয়ে: মাটি পানি আগুন বাতাস ও ব্যোম। ন্যায়-বৈশেষিকদের মতে প্রথম চার উপাদান দুই রকমের: চির ও অচির। প্রতি উপাদানের পরমাণু চির কারণ তা কখনো ধ্বংস হয় না, কিন্তু পরমাণু দিয়ে তৈরি বিভিন্ন বস্তু অচির কারণ সব বস্তুই মরার পরে পরমাণুতে বিলীন হয়ে যায়। পরমাণু সম্ভাব্য সবচেয়ে ছোট কণা, আকৃতি গোল, এদের আর ভাগ করা যায় না। একেক ভূতের পরমাণুর বৈশিষ্ট্য একেক রকম। মাটি-পরমাণুর গন্ধ আছে, পানি-পরমাণুর স্বাদ আছে, আগুন-পরমাণুর রং আছে, আর বাতাস-পরমাণুর স্পর্শক্ষমতা আছে।
[৫] কিন্তু পরমাণুর প্রমাণ কি? ন্যায়-বৈশেষিক যুক্তিটার সাথেও গ্রিক যুক্তির মিল আছে। দৃশ্যমান সব বস্তুর অংশ আছে, সুতরাং দৃশ্যমান ক্ষুদ্রতম বস্তুরও অংশ আছে। দৃশ্যমান ক্ষুদ্রতম বস্তুর অংশটা অবশ্যই অদৃশ্য, কারণ দেখা গেলে সে নিজেই দৃশ্যমান ক্ষুদ্রতম বস্তু হয়ে যেত। সেই অংশ যদি যৌগিক হয় তবে তারও অংশ আছে। কিন্তু এই বিভাজন এক সময় থামতেই হবে, কারণ থামতে না পারলে অনন্ত বিভাজনের ইনফিনিট রিগ্রেস হয়ে যাবে যা একটা ‘অনবস্থা।’ অতএব অবশ্যই ভাঙতে ভাঙতে এক সময় পাওয়া যাবে অংশহীন অবিভাজ্য অদৃশ্য ইন্দ্রিয়াতীত জিনিস, যাদের নাম পরমাণু। প্রশ্ন হল অনন্ত বিভাজন করতে দিলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা হল, সেক্ষেত্রে একটা বিশাল পাহাড় আর একটা সরিষা বিজের সাইজ এক হয়ে যাবে; কারণ দুয়েরই অসীম অর্থাৎ সমান সংখ্যক অংশ থাকবে। কেউ বলতে পারে অনন্ত বিভাজন চলতে পারে যতক্ষণ ভাঙার মতো কিছু একটা থাকে, যখন কিছুই থাকবে না তখন বিভাজন থেমে যাবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সবকিছু ভাঙতে ভাঙতে শূন্য করে ফেলা যাবে, যার অর্থ দাঁড়াবে পুরা মহাবিশ্বটাই শূন্য থেকে সৃষ্টি করা সম্ভব, যেহেতু ভিত্তিতে সেই শূন্যই আছে। কিন্তু শূন্য থেকে সৃষ্টি অসম্ভব। অতএব অবশ্যই পরমাণু আছে যাকে আর ভাঙা যায় না। উল্লেখ্য এই পরমাণুকে আধুনিক বিজ্ঞানের ‘পরমাণু’র সাথে গুলায়ে ফেলা যাবে না কোনভাবেই। আধুনিক ফিজিক্সের পরমাণুর ভিতরে শত শত মৌলিক কণা আছে। এখানে আমরা পরমাণু বলতে সম্ভাব্য সবচেয়ে ছোট কণাটাকে বুঝব, ফিজিক্স যে-দশকে যে-কণাকে ক্ষুদ্রতম বলে ঘোষণা করবে সেই দশকে সেই কণাই আমাদের পরমাণু।
[৬] মৌলিক পরমাণু জোড়া লাগায়ে যৌগিক বস্তু বানানোর সিস্টেমও ন্যায়-বৈশেষিক দার্শনিকরা তৈরি করছিলেন। একই ধরনের দুইটা পরমাণু মিলে একটা দ্ব্যণুক হয়, আর তিনটা দ্ব্যণুক মিলে একটা ত্র্যণুক বানায়, এবং এই ত্র্যণুকই ক্ষুদ্রতম দৃশ্যমান জিনিস। দ্ব্যণুককে আরম্ভকও বলা হয় কারণ এদের থেকেই সৃষ্টির আরম্ভ। ত্র্যণুকেরা নানাভাবে একত্রিত হয়ে বড় বড় সব জিনিস তৈরি করে। বস্তু ত্র্যণুক দ্ব্যণুক সব ধ্বংস হয়ে এক সময় পরমাণু হয়ে যায়, পরমাণু কখনো ধ্বংস হয় না। ভিন্ন ধরনের দুই পরমাণু দ্ব্যণুক বানাতে পারে না কারণ সেক্ষেত্রে মাটি-পরমাণু ও পানি-পরমাণু একসাথে হলে দ্ব্যণুকটা মাটি হবে না পানি? প্রশ্ন হলো, ত্র্যণুকই কেন শুধু যৌগিক বস্তু বানাতে পারে, পরমাণু নিজে বা দ্ব্যণুকেরা নিজে কেন দৃশ্যমান বস্তু বানাতে পারে না? উত্তর, পরমাণু অদৃশ্য হলে দ্ব্যণুকও অদৃশ্য, আর দ্ব্যণুক বা পরমাণু জোড়া লাগায়ে তাই দৃশ্যমান কিছুই বানানো যায় না। একটা যৌগ তিন কারণে বড় হতে পারে, হয় তার অংশগুলা বড়, নয় তার অংশগুলা অনেক ছাড়াছাড়াভাবে বিন্যস্ত, নয় তার অংশের সংখ্যা অনেক। প্রথম ও দ্বিতীয় কারণ ঠিক না, যেহেতু যৌগের অংশ বড় না এবং যৌগের মধ্যে শূন্যস্থানও নাই। তাহলে একমাত্র অনেক অংশ আছে বলেই কোনকিছু বড় ও দৃশ্যমান হতে পারে। অনেক বলতে এখানে তিন দুগুণে ছয়টা বুঝতে হবে, তিনটা দ্ব্যণুক তথা ছয়টা পরমাণু একসাথে হলেই দৃশ্যমান হয়, ত্র্যণুক পাওয়া যায়, এবং যুক্তির প্যাঁচ এড়াতে হলে এখান থেকেই সৃষ্টি শুরু করতে হবে। অনেকের মতে, একেক ভূতের ত্র্যণুক একসাথে হয়ে বড় যৌগ বানাতে পারে এবং এদের মধ্যে বিভিন্ন ভূতের বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ পাওয়া যায়।
[৭] চার ভৌতিক উপাদানের মতো মনও পরমাণু দিয়ে গঠিত। মন-পরমাণুর কোনো ঐন্দ্রিয় বৈশিষ্ট্য নাই। চার ভূত দিয়ে সব পদার্থ তৈরি, পদার্থের মতো মনও মূর্ত, কারণ পদার্থের মতো মনেরও গতি আছে। সব পরমাণু আকার আকৃতিতে একই রকম, কিন্তু গুণের দিক দিয়ে আলাদা। আলাদা উপাদানের পরমাণু আলাদা করা সহজ, কিন্তু একই উপাদানের দুই পরমাণুকে সেক্ষেত্রে কিভাবে আলাদা ভাবা সম্ভব? সম্ভব না বলেই এখানে ন্যায়-বৈশেষিক ধারায় ‘বিশেষ’ নামে একটা আল্টিমেট বিভাজক কল্পনা করা হইছে। বিশেষের কারণেই পরমাণুরা বিশিষ্টতা পায়। এই পরমাণুবাদ কজেশনের সাথে সম্পর্কিত। সাংখ্য দর্শনের ‘সৎকার্যবাদের’ বিপরীতে ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে আছে ‘আরম্ভবাদ’ যার কথা হলো, কজের মাধ্যমে ইফেক্ট বা কারণের মাধ্যমে পরিণাম তৈরি হওয়া মানে একেবারে নতুন কিছু আরম্ভ হওয়া যার অস্তিত্ব আগে ছিল না। কারণ দুই ধরনের: সাধারণ ও অসাধারণ। সাধারণ কারণ সব সময় থাকে, তা তার মাধ্যমে একটা পরিণাম আসুক বা না আসুক। যেমন, স্থান কাল অদৃষ্ট ঈশ্বর, ঈশ্বরের ইচ্ছা ও প্রযত্ন। অসাধারণ কারণ শুধু নির্দিষ্ট পরিণামের জন্য বরাদ্দ এবং এরা তিন রকমের: সমবায়ী, অসমবায়ী, নিমিত্ত। বিশ্বের সমবায়ী কারণ পরমাণু, অসমবায়ী কারণ পরমাণুর সংযোগ, আর নিমিত্ত কারণ ঈশ্বর ও অদৃষ্ট।
[৮] বৌদ্ধ দর্শনের বাস্তববাদী ধারা বৈভাষিক ও সৌত্রান্তিক পরমাণুর কথা বলে। বৈভাষিক মতে পরমাণু হল রূপস্কন্ধের সবচেয়ে ছোট একক। রূপস্কন্ধ হলো পদার্থের সবচেয়ে মৌলিক গাঠনিক বিন্যাস, মৌলিক পদার্থ না বরং বিন্যাস। এই বিন্যাস চার ধরনের: রং স্বাদ স্পর্শ গন্ধ। অভিধর্মকোষে আছে, দৃষ্টির পরমাণু চোখের মণিতে সাজানো থাকে অজাজী ফুলের মতো, শ্রুতির পরমাণু কানের ভিতরে সাজানো থাকে ভূর্জ পাতার মতো, ঘ্রাণের পরমাণু নাকের ভিতরে সাজানো থাকে লম্বা শলাকার মতো, আর রসনার পরমাণু মুখের ভিতরে সাজানো থাকে অর্ধচন্দ্রের মতো। এখানে অদেখা পরমাণুকে দেখা জিনিসের রূপক দিয়ে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে এবং একেক বস্তুর পরমাণু যে একেক রকম সেটাও পরিষ্কার করা হচ্ছে। বৈভাষিক মতে পরমাণু আসলেই অদৃশ্য ইন্দ্রিয়াতীত এবং ক্ষণস্থায়ী কারণ তাদের দশা সব সময় পাল্টায়। সৌত্রান্তিক ধারার কেউ কেউ মনে করে পরমাণু পদার্থ না বরং এক ধরনের অস্থির বল বা শক্তি। পঞ্চম শতকের সৌত্রান্তিক ভিক্ষু বসুবন্ধু বলছিলেন, পরমাণু কখনো একা থাকতে পারে না, সব সময় দল বেঁধে থাকে। সৌত্রান্তিক মতে সাতটা পরমাণু মিলে একটা গুচ্ছ বানায়, তবে সাত জন লাগালাগি অরে থাকতে পারে না, পরমাণুদের মধ্যে শূন্যস্থান বা ভয়েড আছে। সাতটার মধ্যে একটা কেন্দ্রে থাকে, বাকি ছয়টা তার চারদিকে। সর্বাস্তিবাদীরা আট টাইপের পরমাণু চিহ্নিত করছিল। প্রথম চার মুখ্য টাইপ চার মৌলিক পদার্থ মাটি পানি আগুন ও বাতাসের সাথে জড়িত, মাটির পরমাণু কঠিন, পানিরটা তরল, আগুনেরটা গরম, আর বাতাসেরটা গতিশীল। এছাড়া চার টাইপের গৌণ পরমাণু আছে যথাক্রমে রং গন্ধ স্বাদ ও স্পর্শের সাথে সম্পর্কিত। গৌণেরা মুখ্যদের ছাড়া থাকতে পারে না। অর্থাৎ পদার্থ ও তার বৈশিষ্ট্য দুয়ের জন্যই পরমাণু দরকার।
[৯] জৈন দর্শনেও পরমাণুর অভাব নাই। একমাত্র আত্মা ও স্থান ছাড়া সবকিছুই মৌলিক পদার্থ বা পরমাণু দিয়ে তৈরি যাদের নাম পুদ্গল। সব পরমাণু চিরঞ্জীব এবং একটা পরমাণু স্থানের শুধু একটা বিন্দু বা ‘প্রদেশ’ দখল করে থাকে। সব এটমের ধর্ম এক রকম। সবার এক ধরনের স্বাদ গন্ধ ও রং আছে, তবে স্পর্শ আছে দুই ধরনের, ঠাণ্ডা-গরম ও মসৃণ-অমসৃণ। অন্য সব ধরনের স্বাদ গন্ধ রং ও স্পর্শ একাধিক পরমাণুর মিলনে তৈরি হয়। এটম সাধারণত গতিশীল তবে স্থিরও থাকতে পারে। স্থানকালের প্রকৃতি অনুযায়ী এদের গতি নিয়মিত বা অনিয়মিত হয়। পরমাণু সাধারণত সরলরেখা বরাবর চলে কিন্তু অন্য পরমাণুদের সাথে মিথস্ক্রিয়ার কারণে বাঁকা পথে চলতে পারে। এটমের গতি কখন বেশি কখন কম তা নিয়েও জৈনরা ভাবছেন।
[১০] বৌদ্ধ-জৈন পরমাণুবাদের সাথে ন্যায়-বৈশেষিক পরমাণুবাদের একটা বড় পার্থক্য আছে পরমাণু কিভাবে মিলিত হয় সেই বিষয়ে। ন্যায়-বৈশেষিক মতে পরমাণু মিলতে পারে কোনো অতিপ্রাকৃত বা ঐশ্বরিক শক্তি আর অদৃষ্টের মাধ্যমে। কিন্তু বৌদ্ধ ও জৈনরা মিলন ব্যাখ্যার জন্য শুধু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াই ব্যবহার করছে। জৈন দর্শনের একটা উপমা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। পানির ফোঁটা যবের দানার উপর পড়লে প্রথমে একটা দলা তৈরি হয়, এ থেকে বুঝা যায় স্নিগ্ধ পরমাণু রুক্ষ পরমাণুর সাথে মিলতে চায়। স্নিগ্ধতা ও রুক্ষতা বা মসৃণতা ও অমসৃণতা নিঃসন্দেহে প্রাকৃতিক। বলা যায় জৈনরাই প্রথম বলছিল যে বিপরীত মিলতে চায়, পজিটিভের সাথে নেগেটিভ, ধনাত্মকের সাথে ঋণাত্মক। এক রকমের পরমাণুও মিলতে পারে, তবে সেক্ষেত্রে একটার তীব্রতা আরেকটা থেকে ভিন্ন হতে হবে, যেমন দুই স্নিগ্ধতার পরমাণু চার স্নিগ্ধতার পরমাণুর সাথে মিলতে পারে। বেশি তীব্র পরমাণু কম তীব্রটাকে পুরাপুরি খেয়ে ফেলে, চারের সাথে দুই মিললে মিলিত গুচ্ছটার তীব্রতাও চার হয়, ছয় না। বৈভাষিক দার্শনিক শুভগুপ্ত মিলন বা বিক্রিয়ার আরেকটা তত্ত্ব দিছেন। তার মতে প্রতিটা পরমাণুর একটা ‘দ্রব্যশক্তি’ (বন্ধনশক্তি) আছে যা নির্ধারণ করে সে কার সাথে কিভাবে মিলিত হবে, বিক্রিয়া করবে। পরমাণু একটার সাথে আরেকটা কখনো পুরাপুরি মিশে যায় না বরং দ্রব্যশক্তির কারণে কাছাকাছি এসে গুচ্ছ তৈরি করে। অনেক পরমাণুর বন্ধনশক্তি এতই কম যে কখনোই কারো সাথে মিলতে পারে না। দুইটা পরমাণু দ্রব্যশক্তির কারণে কাছাকাছি আসলে, তাদের জুটির বৈশিষ্ট্য দুইটা পরমাণু থেকেই আলাদা হয়, বন্ধনের মাধ্যমে নতুন বৈশিষ্ট্য ও নতুন ধরনের বস্তু তৈরি হয়।
[১১] চার্বাকরা ছিল সবচেয়ে কট্টর প্রকৃতিবাদী, দেখা যায় না এমন কিছুই বিশ্বাস করত না, পরমাণু ঈশ্বর আত্মা আকাশ কিছুই না। যে চার রকমের পদার্থ দেখা যায় তারাই মৌলিক, মাটি পানি আগুন বাতাস। এদের অন্তর্নিহিত কিছু ‘স্বভাব’ আছে, এছাড়া আর কিছুই তাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে না। জগতের সব কিছু এই চার পদার্থের মিলনে তৈরি হয়। চার্বাকরা ‘কারণেও’ বিশ্বাস করত না যেহেতু ‘কারণ’ দেখা যায় না। ঢিল মারলে গাছ থেকে আম পড়ে, কিন্তু ঢিল আর আমের মধ্যে কারণ নামে তৃতীয় আরেকটা কিছু কখনোই দেখা যায় না। ঢিল আর আমই বাস্তব আর কিছু নাই। প্রত্যেক বস্তু বা ঘটনা তার স্বভাব দিয়ে পুরাপুরি নির্ধারিত, স্বভাব ছাড়া আর কিছু আনার দরকার নাই। তার মানে বিশ্বের সবকিছু আকস্মিকভাবে ঘটে কোনো কারণ ছাড়া, এই মতবাদের নামই আকস্মিকতাবাদ। একটা কদাচিৎ (চিরন্তন না এমন) ঘটনাকে আমরা যতই সাপেক্ষ মনে করি, আসলে সে কারো অপেক্ষা করে না, আকস্মিকভাবে ঘটে।
[১২] আকস্মিকতাবাদের পাঁচ ধরনের ব্যাখ্যা দেয়া যায় ‘অকস্মাৎ’ শব্দটার উপর নির্ভর করে: কোনো পরিণাম কোনো কারণ থেকে জন্মায় না, পরিণাম বলেই কিছুই ঘটে না, পরিণাম স্বয়ম্ভূ বা আত্মঘটিত, পরিণাম কোনো অবাস্তব কারণ থেকে আসে, অথবা পরিণাম তার নিজের স্বভাব থেকে আসে। এগার শতকের ন্যায় দার্শনিক উদয়ন পাঁচটা ব্যাখ্যাই উড়ায়ে দিছিলেন। প্রথমত, পরিণাম কারণ থেকে না জন্মাইলে যেকোনো সময় জন্মাইতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তার ‘কদাচিৎ’ প্রকৃতিটাই থাকে না, সে চিরন্তন হয়ে যায়। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা ধোপে টিকে না কারণ আমরা পরিণাম বা ইফেক্ট সব সময় দেখি। তৃতীয়টা অসম্ভব কারণ কোনকিছু একইসাথে কারণ ও পরিণাম হতে পারে না, সেক্ষেত্রে একটা জিনিসকে তার জন্মের আগেই উপস্থিত থাকতে হবে। চতুর্থটা চলেই না কারণ অবাস্তব কিছু বাস্তব কিছু ঘটাতে পারে না। পঞ্চমটা ভুল কারণ পরিণামের স্বভাব হয় পরিণামের মতো বা আলাদা হতে হবে। আলাদা হলে সেই আলাদা স্বভাবের জিনিসটাকে কারণ বলতে হবে। আর যদি এক হয় তাহলে আমরা ইনফিনিট রিগ্রেসে হারায়ে যাব, একই স্বভাবের জিনিস একই স্বভাবের জিনিস বানাতেই থাকবে। এই যুক্তিগুলা ন্যায্য হতে পারে, হাজার হোক ন্যায় দর্শন থেকেই আসছে। কিন্তু প্রকৃতিকে কেন আমাদের যুক্তির মতো হবে? কারণ বলে কিছু তো নাও থাকতে পারে, হয়ত কারণের বদলে স্বভাব না থাকলেও আছে স্থানকালের চতুর্মাত্রিক বিন্যাস।
[১৩] প্রাচীন ভারতে প্রধানত দুইটা পরমাণুবিরোধী মতবাদ ছিল: সাংখ্য দর্শনের প্রকৃতিপরিণামবাদ, বেদান্তের ব্রহ্মকারণবাদ। এখানে বিশ্বকে কোনো অংশে ভাঙা হয় না, বিশ্ব একটা একক অবিচ্ছিন্ন চিরন্তন জিনিস দিয়ে বানানো, সাংখ্য মতে সেই জিনিস ‘প্রকৃতি’ আর বেদান্ত মতে ‘ব্রহ্ম’। আমরা প্রথমটাই আলোচনা করব, তবে এখানে ‘প্রকৃতি’ শব্দটাকে বিশেষ অর্থে নিতে হবে, এতক্ষণ যে অর্থে ইউজ করছি বা এই আর্টিকেলের নামে যেই অর্থে ইউজ করা হইছে সেটা না। সাংখ্য মতে প্রকৃতি এক চিরচঞ্চল সর্বব্যাপী সত্তা যার আছে শুধু তিনটা গুণ: সত্ত্ব রজঃ তমঃ। সত্ত্ব আলোকিত করে, রজঃ সচল করে, তমঃ বাধা দেয়। হতে পারে সত্ত্ব রূপ, রজঃ শক্তি, আর তমঃ পদার্থ। বা হয়ত এই ত্রিগুণ আসলে প্রকৃতিকে চেতনা যেভাবে অনুভব করে সেই সব অনুভূতির নাম। ত্রিগুণ পদার্থের মৌলিক উপাদান না, বরং অনুভূতির মৌলিক উপাদান যাদের মাধ্যমে সব অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। সবার উপরে সত্ত্ব যা এক সদা-সক্রিয় কষ্ট। কষ্ট মানেই কষ্ট থেকে মুক্তির বাসনা, তাই কষ্ট সব সময় মুক্তির পথে সক্রিয়, কষ্ট মানে মুক্তির অশান্ত ইচ্ছা। রজঃ এক ধরনের তুষ্টি, কষ্টের বিপরীত, কষ্ট থেকে শান্তির মুক্তি। আর তমঃ এক ধরনের অনীহা, যখন মুক্তির অক্রিয় ইচ্ছা থাকে, সেই ইচ্ছাকে বাস্তবায়নের তাড়না থাকে না। এই তিন গুণ বাস্তবতার সবকিছুতে বিরাজমান, এরা একইসাথে নির্মাণ করে অভিজ্ঞতা আর অভিজ্ঞতার বস্তু।
[১৪] প্রকৃতির সাথে যোগ করা হইছে পরিণাম ও পরিণামের কারণ। সাংখ্য মতে কারণের মধ্যেই পরিণাম সুপ্ত থাকে। এর পক্ষে যুক্তিগুলা এই রকম। যার অস্তিত্ব নাই তা কখনো তৈরি করা সম্ভব না, অস্তিত্বশীল চিরকাল অস্তিত্বশীল, অস্তিত্বহীন চিরকাল অস্তিত্বহীন, তাই পরিণাম কারণের মধ্যে আগে থেকে না থাকলে কখনোই অস্তিত্ব পেতে পারে না। তাছাড়া, কারণ তখনি পরিণাম বানাতে পারে যখন তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকে, কিন্তু দুইটা জিনিস না থাকলে কোনো সম্পর্ক হয় না, তাই কারণ পরিণাম দুইটাই সব সময় থাকতে হবে। অবশ্য কারণ ও পরিণামের মধ্যে সম্পর্কটা অভিন্নতার, অভিন্ন হলে তো দুইটাকে একসাথে থাকতেই হবে। সাংখ্য মতে কারণ ও পরিণাম এসেন্সের দিক দিয়ে এক কিন্তু ফর্মের দিক দিয়ে আলাদা, এদের স্বভাব এক তবে রূপ আলাদা। রূপের দিক থেকে আলাদা হলেও তারা এক জিনিস, সুতরাং কারণ থাকলে পরিণামকেও থাকতে হবে। সাংখ্য মতে সবকিছু এক প্রকৃতির বিবর্তন মাত্র, নতুন কিছু সৃষ্টি হয় না, কারণের মধ্যেই পরিণাম থাকে যেহেতু দুইটাই প্রকৃতির বিবর্তন। তবে বেদান্তের সাথে সাংখ্যের পার্থক্য হল, বেদান্তমতে একমাত্র ব্রহ্মই বাস্তব, ব্রহ্ম থেকে তৈরি বিশ্ব মায়া, আর সাংখ্য মতে প্রকৃতি ও প্রকৃতির বিবর্তন দুইটাই বাস্তব, কোনটাই মায়া না।
[১৫] ‘প্রকৃতি’র বিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের প্রত্যক্ষ জগৎ তৈরি হইছে। এই বিবর্তনের একটা ধারাবাহিকতা আছে। প্রকৃতির প্রথম বিবর্তিত রূপ মহৎতত্ত্ব, অন্য নাম মহাজাগতিক বুদ্ধি বা মহাবুদ্ধি। মহৎতত্ত্ব থেকে আবির্ভূত হইছে অহংকার বা আত্মচেতনা। অহংকারের সত্ত্ব-রূপ থেকে আসছে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় (নাক কান চোখ জিহ্বা ত্বক), পাঁচ চলনেন্দ্রিয় (হাত পা বচন জনন নিঃসরণ) এবং মন। অহংকারের তমোরূপ থেকে তৈরি হইছে পাঁচ তন্মাত্র: শব্দ স্পর্শ রং স্বাদ গন্ধ। এই পাঁচ সূক্ষ্ম তন্মাত্র থেকে আসছে পাঁচ স্থূল পদার্থ: আকাশ বাতাস আগুন পানি ও মাটি। প্রকৃতির তিন উপাদান বা গুণ সত্ত্ব রজঃ তমঃ সব সময় রূপান্তরের মধ্যে থাকে, অর্থাৎ বিভিন্ন পরিণামের মধ্য দিয়ে যায়। প্রত্যক্ষ জগতের জন্মের আগে প্রকৃতির পরিণাম ছিল সদৃশ বা সমসত্ত্ব; তখন সত্ত্ব থেকে সত্ত্ব, তমঃ থেকে তমঃ আর রজঃ থেকে রজঃ পরিণামই ঘটত। জগতের জন্মের সময় রজঃ অন্য দুইটার উপর প্রভাব বিস্তার করে, ‘পুরুষের’ কাছে আসার কারণে প্রকৃতির স্থিতি নষ্ট হয়, যেভাবে চুম্বকের আকর্ষণে অস্থির হয় লোহা। পুরুষ প্রকৃতির সমান সনাতন এক সত্তা যার আরেক নাম আত্ম। পুরুষ ও প্রকৃতির আকর্ষণে শুরু হয় অসমসত্ত্ব বিবর্তন, প্রকৃতির এক গুণ আরেক গুণের সাথে বিভিন্ন অনুপাতে মিশে নির্মাণ করে আমাদের জগৎ। প্রকৃতির বিবর্তনের লক্ষ্য পুরুষের সুখ ও মোক্ষ। তাই পুরুষ নিজে এই বিবর্তনের বাইরে থাকে। মহাবুদ্ধি সৃষ্টির সময় পুরুষ নিজের পরিচয় সেই বুদ্ধির মধ্যে বিলীন করে দেয়ার মাধ্যমে ভোগের অনুভূতি অর্জন করে। পরে প্রকৃতি তার বিবর্তনের ধারায় যখন ভেদজ্ঞান সৃষ্টি করে তখন সেই জ্ঞানের মাধ্যমে পুরুষ আবার সুখদুঃখভোগ থেকে মোক্ষ লাভ করে। পুরুষ প্রকৃতির সমান সনাতন হলেও নিয়ন্ত্রণ প্রকৃতির হাতে। প্রকৃতিই পুরুষকে ভোগের বন্ধনে আবদ্ধ করে এবং আবার ভেদবুদ্ধির মাধ্যমে মুক্তি দেয়। পুরুষ নিজেকে চিরস্বাধীন মনে করে, যদিও আসলে প্রকৃতি তার আত্মায় বসে বারবার বাঁধতেছে আর খুলতেছে ভোগের দড়ি। প্রকৃতির বিবর্তন কেবল পুরুষের স্বার্থে।
[১৬] বেদান্তের মতো সাংখ্য দর্শনেও দ্বৈত আর অদ্বৈতের এক দ্বন্দ্ব দেখা যায়। অদ্বৈত বলে কেবল প্রকৃতিই বাস্তব, পুরুষ প্রকৃতির চেতনা ছাড়া আর কিছু না। দ্বৈত বলে পুরুষ আর প্রকৃতি আলাদা। আদি যুগে সাংখ্যে অদ্বৈতের প্রভাব বোধহয় বেশি ছিল, যেমনটা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের বইয়ে পাওয়া যায়। সনাতন প্রকৃতির এক অব্যক্ত অংশ হলো পুরুষ বা আত্মচেতনা। প্রকৃতি নিজের অব্যক্ত পুরুষকে বিবর্তনের ধারায় এক সময় ব্যক্ত করে। এই প্রক্রিয়া অনেকটা পরমাণু দিয়ে গড়া নিছক প্রাণী থেকে আত্মসচেতন ব্যক্তি সৃষ্টির মতো। প্রকৃতি যতকাল অচেতন থাকে ততকাল সুখদুঃখ ভোগ করে না, পুরুষের প্রকাশের মাধ্যমে সে সচেতন হওয়ার সাথেসাথেই খুলে যায় ভোগের ভুবন। প্রকৃতির আত্মচেতনার নাম পুরুষ। পুরুষ বিবর্তনের ঊর্ধ্বে থেকে প্রকৃতির লীলা উপভোগ করে, বা বলা উচিত সক্রিয় প্রকৃতি অক্রিয় পুরুষকে সুখদুঃখ ভোগ করায়। প্রকৃতি সূর্য, পুরুষ সূর্যের আলো বা আত্ম, মহাবুদ্ধি বা মহৎতত্ত্ব চাঁদ; চাঁদের আলো না থাকলেও সূর্যের আলো প্রতিফলিত করার মাধ্যমে সে রাত্রিকে আলোকিত করে; তেমনি বুদ্ধি আত্মকে প্রতিফলিত করার মাধ্যমে জগতকে আলোকিত করে অর্থাৎ সচেতন করে। সৌরজগতের সবকিছু যেমন সূর্যের অংশ, তেমনি বিশ্বজগতের সবকিছু প্রকৃতির অংশ। সূর্যের আলো যেমন সূর্যের অংশ পুরুষও তেমনি প্রকৃতির অংশ। তবে পুরুষকে পুং আর প্রকৃতিকে স্ত্রী লিঙ্গ মনে করা উচিত না।
[১৭] মন আত্ম ও চেতনা অধিকাংশ ভারতীয় দর্শনে প্রকৃতির অংশ। চার্বাকরা কঠিন প্রকৃতিবাদী, বেদান্তীরা অতিপ্রাকৃতবাদী, তবে মাঝের সবাই এক ধরনের সহজ প্রকৃতিবাদ সমর্থন করে। সহজিয়া মতে আত্মের আলাদা জায়গা আছে তবে প্রকৃতির বাইরে না। মীমাংসার প্রভাকরবাদ আর ন্যায়-বৈশেষিক ও জৈন দর্শনে প্রকৃতির সংজ্ঞা ব্যাপক, মন দেহ চেতনা আবেগ সব প্রাকৃতিক। দেহ আর মস্তিষ্কের জগৎ থেকে মন আর চেতনার জগতকে আলাদা করে ফেললে যে মাইন্ড-বডি সমস্যার জন্ম হয় তা তাই ভারতীয় দর্শনে নাই। আবার দেহ-মস্তিষ্ক বা পদার্থ ছাড়া আর কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার না করলে যে ‘সায়েন্টিফিক রিডাকশন’ সমস্যা তৈরি হয় সেটাও ভারতে নাই, কারণ মন-চেতনা দেহ-মস্তিষ্কের সাথে থাকলেও আলাদা জিনিস। বেদান্তকে শুরুতে যতটা অতিপ্রাকৃত মনে হয় আরেকটু চিন্তা করলে সেটা আর থাকে না। উপনিষদ মতে ব্রহ্ম সমান আত্ম। শুরুতে ব্রহ্ম ছিলেন এক সচ্চিদানন্দ। সেই এক যখন বহু হইতে ইচ্ছা করিলেন তখন বিশ্বের জন্ম হইল। জন্ম দেয়ার পরে সেই বিশ্বের ভিতরে ব্রহ্ম নিজেই প্রবেশ করলেন। ব্রহ্ম বিশ্বের কতটা ভিতরে আর কতটা বাহিরে তা নিয়ে অবশ্য বেদান্তে মতভেদ আছে। শংকরের মতে ব্রহ্ম তার মায়া দিয়ে অভিক্ষেপ হিসাবে বিশ্ব বানান, বিশ্ব তাই পুরা বাস্তব না, পরাবাস্তব কি না চিন্তা করে দেখা যায়। শংকরের ব্রহ্ম প্রকৃতির বাইরে। তবে বেদান্তের অন্য অনেক ধারায় বিশ্বকে ব্রহ্মের বাস্তব বিবর্তন হিসাবেই দেখা হইছে। এই মত সমর্থন করেন রামানুজ, মাধব, নিম্বার্ক, ভাস্কর, বল্লভ, শ্রীচৈতন্য। আত্মের মধ্যে ব্রহ্ম আসলেই উপস্থিত, আত্ম দেহের সুখদুঃখের জীবন উপভোগ করতে বাধ্য, কিন্তু তার চূড়ান্ত লক্ষ্য দেহ থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বপূর্ব ব্রহ্মের সচ্চিদানন্দ রূপ নিজের মধ্যে উপলব্ধি করা। আত্মের উদ্দেশ্য উপভোগ থেকে উপলব্ধির দিকে যাওয়া।
[১৮] চার্বাক মতে চেতনা চার ভৌত উপাদান মাটি-পানি-পাবক-পবন থেকেই আবির্ভূত হয়, তার কোনো আলাদা গাঠনিক উপাদান নাই। সুপারিতে লাল রং না থাকলেও সুপারি চিবাইলে যেভাবে মুখ লাল হয় সেভাবেই অচেতন বস্তু থেকে চেতনা আবির্ভূত হয়। হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মিলে যেভাবে একেবারে অন্য রকম পানির জন্ম দেয় সেভাবেই জড় পদার্থ থেকে চেতনার আবির্ভাব ঘটে। অনেকে ভূত থেকে এভাবে চেতনা আবির্ভূত হওয়াকে এক ধরনের রিডাকশন হিসাবে দেখেন। কিন্তু টরন্টোর জনার্দন গণেরির মতে চার্বাক দর্শনে রিডাকশন নাই, আছে সুপারভেনিয়েন্স বা অধ্যাবর্তন, মধ্যবর্তন না, অধ্যাবর্তন, যদিও এর সাথে অধ্যাত্মের সম্পর্ক নাই। চেতনা বস্তুর মধ্যবর্তী না, অধ্যাবর্তী। বাস্তবতার একটা অধ্যাবর্তী ভিত্তি আছে যা থেকে সব কিছু ইমার্জ করে, ভূত থেকেই সব আবির্ভূত হয়, তবে চার্বাক ভূতের মধ্যে অদ্ভুত কিছু একটা আছে।
[১৯] ন্যায়-বৈশেষিক মতে চেতনা চার্বাক ও বেদান্ত ধারার মতন অপরিহার্য বা স্বাভাবিক (এসেনশিয়াল) কিছু না বরং আত্মের ‘আগন্তুক’ গুণ। কারণ আত্ম কেবল দেহের মধ্যে আবদ্ধ হলেই সচেতন হয়। বিদেহী আত্ম অচেতন। আত্মের সাথে সম্পর্কিত শরীর ইন্দ্রিয় অর্থ বুদ্ধি মন ইত্যাদি। আত্ম সব কিছু দেখে, জানে, উপভোগ করে, অনুভব করে। শরীর সব অভিজ্ঞতার স্থান। ইন্দ্রিয় সব জ্ঞান ও ভোগের উপায়। মনের মাধ্যমে ভিতরের সব অবস্থার অন্তর্বীক্ষণ ঘটে। প্রবৃত্তি সব শারীরিক ও মানসিক কাজের চালক। প্রেত্যভাব হলো মোক্ষের আগ পর্যন্ত আত্মের জন্মমৃত্যুর ধারা। জন্ম মানে শরীর ইন্দ্রিয় ইত্যাদির সাথে আত্মার যোগ, মৃত্যু মানে বিয়োগ। কর্মের ফল শুধু দুইটা: কষ্ট বা তুষ্টি। এই হলো আত্মের অভিজ্ঞতা। জন্মমৃত্যুর ধারা থেকে মুক্তির উপায় আত্মকে অনাত্ম থেকে আলাদা করে এমন সব কিছু জানা। আর এই কাজ শরীর ছাড়া অসম্ভব। তাই যে মুক্তি খুঁজতেছে সে আসলে বিদেহী আত্ম না, বরং আত্মশরীর, আত্ম আর শরীরের যোগে তৈরি একটা কমপ্লেক্স।
[২০] বৌদ্ধ নিকায়ে চেতনাকে দেখা যায় মানুষের জন্ম ও বন্ধনের কারণ হিসাবে চিহ্নিত ভবচক্রের দ্বাদশাঙ্গের একটা হিসাবে। চেতনা হলো অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সংযোগ। চেতনা তৈরি হয় অবিদ্যা ও কর্মের মাধ্যমে, অবিদ্যা ও কর্ম থেকে আসে নাম ও রূপ, আর নাম-রূপ দিয়েই বন্দি মানুষের শরীর মন তৈরি। ভবচক্রের বারো অঙ্গের প্রতিটা একইসাথে নিরূপক ও নিরূপিত। চেতনা অভিজ্ঞতার নিরূপক এবং অভিজ্ঞতা দিয়েই নিরূপিত। মানুষ যখন বুঝতে পারবে দুনিয়ার সব সুখের অনুভূতি ক্ষণস্থায়ী তখন তার তৃষ্ণা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, ভেঙে যাবে ভবচক্র, আসবে নির্বাণ। আর যদি আপাত আনন্দের মধ্যে ডুবে থাকে, তবে তার ভবিষ্যৎ জন্ম ঠেকানো যাবে না, সংসারের চক্র আর বেদনা তার জন্য চলবে চিরকাল। সংসার ও আত্মচেতনা তাই বুদ্ধ এক ধরনের প্রতীত্য-সমুৎপাদ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। আত্মও ক্ষণস্থায়ী, পাঁচটা স্কন্ধের সমাহার। স্কন্ধ পাঁচটা হলো রূপ (পদার্থ), বেদনা (অনুভূতি), সংজ্ঞা (উপলব্ধি), সংস্কার (প্রবণতা), বিজ্ঞান (চেতনা)। চেতনা ছয় ধরনের: দর্শন শ্রবণ ঘ্রাণ রসন স্পর্শ ও মানসিক। প্রতি চেতনার সাথে একটা বস্তুকাঠামো আছে, দর্শনের সাথে চক্ষুচেতনা, শ্রবণের সাথে কর্ণচেতনা, ঘ্রাণের সাথে নাসিকাচেতনা, রসনের সাথে জিহ্বাচেতনা, স্পর্শের সাথে দেহচেতনা, আর ভাবনার সাথে মনোচেতনা। চেতনা সব সময়ই কোনো বস্তুর চেতনা, বস্তুনিরপেক্ষ বিশুদ্ধ চেতনা বলে কিছু নাই।
[২১] তান্ত্রিক প্রকৃতিবাদ দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো তান্ত্রিক বা পদ্ধতিগত সীমারেখা টানে না। পশ্চিমে বিজ্ঞান ও দর্শন একসাথেই যাত্রা শুরু করছে, পরে যে-বিজ্ঞান পরীক্ষণ ও বীক্ষণে যত বেশি উন্নতি করতে পারছে সে তত আগে দর্শন থেকে আলাদা হয়ে গেছে, এবং একটা বিজ্ঞান উন্নতির শিখরে উঠার পরে আবার তার মাতৃদর্শনের সাথে এক ধরনের আন্তঃবিভাগ সংঘ তৈরি করছে। কিন্তু সেই পুরাতন দর্শন সব সময় তত্ত্ববিদ্যার বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে তার সন্তান বিজ্ঞানগুলার সীমানা পাহারা দেয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে দুই দিক থেকে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে সংঘর্ষ তৈরি হইছে, এক দিকে সন্তান বড় হয়ে বাপমায়ের সাথে দ্বন্দ্ব করছে, আরেক দিকে বাপমা সব সময় সন্তানকে পাহারা দেয়ার নামে আরেক দ্বন্দ্বের জন্ম দিছে, একটা সন্তানের বিদ্রোহ আরেকটা বাপমায়ের সন্দেহ। এই দুই দ্বন্দ্ব সব সময় নিষ্ফল ছিল না। ভারতে অবশ্য এই রকম কোনো দ্বন্দ্বের জন্মই হয় নাই। কারণ এখানে বিজ্ঞান ও দর্শনের জমি সেভাবে ভাগাভাগিই করা হয় নাই পশ্চিমের সাথে পরিচয়ের আগে। ভারতে দর্শনের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মুক্তি, তবে সেই মুক্তি সম্ভব কেবলমাত্র বিশ্বকে বৈজ্ঞানিকভাবে বুঝার মাধ্যমে, কারণ বিশ্বের প্রকৃতিই মুক্তির উপায় বাতলায়ে দিবে। এই ধরনের দর্শনকে এজন্যই ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বলছিলেন ‘ইতিবাচক’ বিজ্ঞান। ভারতে আয়ুর্বেদ ও আলকেমির মতো ‘ফলিত’ বিজ্ঞান দর্শন থেকে নিজেদের কিছুটা আলাদ করছিল, কিন্তু দর্শনের তান্ত্রিক ঋণ পরিশোধ করতে পারে নাই।
[২২] দর্শনতন্ত্র অর্থাৎ পদ্ধতির দিক দিয়ে প্রকৃতিবাদ ও বৈজ্ঞানিকতা বুঝতে হলে ন্যায় দর্শনের পদ্ধতি নিয়ে কথা বলতে হবে, এই মেথডই সবচেয়ে রিগোরাস। নৈয়ায়িকরা অনুসন্ধানের একটা সুন্দর মেথড তৈরি করছে যা বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও কাজে লাগতে পারে। এর চারটা ধাপ: উদ্দেশ লক্ষণ পরীক্ষা ও নির্ণয়। প্রথম ধাপে একটা বিষয়ের সবগুলা বিভাগের (শ্রেণী) উদ্দেশ বা সন্ধান দেয়া হয়। দ্বিতীয় ধাপে বিষয়টার সংজ্ঞা দেয়া হয় তার অনন্য সব লক্ষণের মাধ্যমে। তৃতীয় ধাপে সংজ্ঞাটা পরীক্ষা করা হয়। আর চতুর্থ ধাপে সংজ্ঞাটা সঠিক কি না তা নির্ণয় করা হয়। অনেক সময় শ্রেণিবিন্যাস সংজ্ঞার পরে আসতে পারে। এই প্রসেসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে ‘সিদ্ধান্ত’ হিসাবে গ্রহণ করা হয়। ন্যায় তত্ত্ববিদ্যা অনুসারে কাণ্ডজ্ঞান বিজ্ঞান যুক্তিবিদ্যা আর ধর্মগ্রন্থের মধ্যে বড় ব্যবধান নাই।
[২৩] পাশ্চাত্য দর্শনের দুইটা প্রধান তত্ত্ববিদ্যা হলো ন্যাচারালিস্টিক ও এনালাইটিক, প্রাকৃত ও বিশ্লেষী। বিশ্লেষী বেশি প্রভাবশালী এবং এর দাবি মূলত তিনটা। এক, তত্ত্ববিদ্যা পুরাপুরি স্বায়ত্ত্বশাসিত, কারো উপর নির্ভর করে না, মানুষের সব জ্ঞান অর্জনের ভিত্তি নিয়ে কাজ করে। দুই, তাত্ত্বিক সব প্রতিপাদন আপ্রায়োরি, ন্যায্যতা প্রতিপাদনের সাথে কারণ বা নিমিত্তের কোনো সম্পর্ক নাই, একটা কথা ‘ক’ সত্য কি না বুঝার জন্য ‘ক’ অন্য সব প্রতিজ্ঞার সাথে যৌক্তিকভাবে যায় কি না জানাই যথেষ্ট। তিন, মনের বাইরের সবকিছুর জ্ঞান কেবল মনের ভিতরের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই অর্জন করা যায়। প্রাকৃত তত্ত্ববিদ্যায় তিনটাই অস্বীকার করা হয়। এক, তত্ত্ববিদ্যা বিজ্ঞানের আওতার বাইরের কিছু না, সে বিজ্ঞানকে জ্ঞানের ভিত্তি দিতে পারে না। দুই, তত্ত্ববিদ্যায় কারণ নিয়ে আলোচনা করতে হবে, মনস্তত্ত্ব নিয়ে কথা বলতে হবে। তিন, ভিতর দিয়ে বাহির প্রতিপাদন করা যায় না, সুতরাং প্রতিপাদনের কাজ তত্ত্ববিদ্যাকে হয় পুরা বাদ দিতে হবে নয় অন্য কোনো উপায়ে করতে হবে। পাঁচ হাজার মাইল দিয়ে পৃথক দুই জায়গার দর্শনের তুলনা করা কঠিন, যদি করতেই হয় তবে ভারতের বেশির ভাগ তত্ত্ববিদ্যাকে প্রাকৃতটার সাথেই মিলাতে হবে। কারণ ভারতের প্রতিটা ধারা যার যার ‘প্রমা’ প্রমাণের জন্য যুক্তি তৈরি করছিল অন্য সব ধারার জবাবে। একেক ধারার সত্ত্ববিদ্যা একেক রকম হলেও তত্ত্ববিদ্যার দিক দিয়ে সবাই মনন ও কারণের উপর গুরুত্ব দিছে। প্রাকৃতিক জগতের জ্ঞান শুধু অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই পাওয়া যায় মনে করছে। ভারতের দর্শনে তাই আপ্রায়রি আপস্টেরিয়রি ভাগ নাই, নেসেসিটি পসিবিলিটি ভাগ নাই, এনালাইটিক সিন্থেটিক ভাগ নাই।
[২৪] নৈয়ায়িকরা বিরোধিতার জবাব কিভাবে দিতেন? দুই ধাপে। প্রথম ধাপে ‘সত্য বিশ্বাস’ অর্জনের নির্ভরযোগ্য শুদ্ধ পদ্ধতি তুলে ধরতেন, দ্বিতীয় ধাপে সেই পদ্ধতি অনুমোদন করতেন। ন্যায় মতে ‘সত্য বোধ’ বা ‘প্রমা’ চার ধরনের (প্রত্যক্ষ অনুমিতি উপমিতি শব্দ) এবং প্রমা অর্জনের উপায় বা ‘প্রমাণ’ও যথাক্রমে চার ধরনের (প্রত্যক্ষ অনুমান উপমান শব্দ)। প্রত্যক্ষ অনুমান ও উপমানের অর্থ বুঝাই যাচ্ছে, শব্দ মানে অথরিটি যেহেতু বেদের অথরিটি শব্দের মাধ্যমে প্রচারিত হতো। তবে এই প্রক্রিয়ায় সত্য বিশ্বাস আসতে পারে যদি সাথে থাকে সত্যিকারের গুণ। কি এই গুণ? একেক প্রমার গুণ একেক রকম। প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়ের সাথে বস্তুর সম্পর্ককে বলা হয় গুণ, সম্পর্ক গুণবান হলে বোধটাও সত্য বিশ্বাস হবে, আমার কোভিড না থাকলে খাবারের স্বাদ ঠিকভাবে পাব কারণ আমার জিহ্বার সাথে খাদ্যের সম্পর্কটা সঠিক হবে। অনুমানের ক্ষেত্রে গুণ হলো চিহ্ন। যেমন দূরের পাহাড়ে আগুন লাগছে এই অনুমিতি করা যায় তখনি যখন পাহাড়ের উপরে আগুনের একটা চিহ্ন, যেমন ধোঁয়া, দেখা যায়। উপমিতির ক্ষেত্রে গুণ হলো মিল। কোনো প্রাণীকে বাইসন মনে করা যায় এই উপমানের উপর ভিত্তি করে যে বাইসনের সাথে গরুর মিল আছে। শব্দের ক্ষেত্রে গুণ হলো বক্তার দক্ষতা অভিজ্ঞতা অব্যর্থতা। সত্য বিশ্বাস যেমন গুণ থেকে আসে মিথ্যা বিশ্বাস তেমনি আসে দোষ থেকে, শুধু গুণের অভাব থেকে না। সাদা দুধকে কেউ হলুদ ভাবতে পারে হয় তার চোখের নয় দুধের গ্লাসের দোষের কারণে। তবে এখানে কাকতাল বলেও একটা ব্যাপার আছে। পাহাড় চূড়ায় কুয়াশাকে ধোঁয়া ভেবে কেউ এই মিথ্যা বিশ্বাস করতে পারে যে চূড়ায় আগুন লাগছে, কিন্তু হয়ত চূড়ায় আসলেই আগুন লাগছে যার ধোঁয়া কুয়াশার কারণে দেখা যাচ্ছে না। এখানে মিথ্যা বিশ্বাসটা কাকতালের কারণে আসলেই সত্য হয়ে গেছে, বিশ্বাস কাকতালীয়ভাবে সত্য হলেও বিশ্বাস অর্জনের পদ্ধতি মিথ্যা। তাই নৈয়ায়িকরা মনে করতেন, বিশ্বাস মিথ্যা হলে অবশ্যই পদ্ধতিতে দোষ আছে, তবে পদ্ধতিতে দোষ থাকলেই বিশ্বাস মিথ্যা নাও হতে পারে। মিথ্যা বিশ্বাসের জন্য পদ্ধতির দোষ নেসেসারি তবে সাফিশেন্ট না। ন্যায় দর্শনের প্রমা ও প্রমাণের সাথে প্লেটোর ন্যায্য সত্য বিশ্বাস মিলানো যায়।
[২৫] বাচস্পতি মিশ্র থেকে শুরু করে পরের অনেক নৈয়ায়িক মনে করতেন, যেহেতু বিশ্বাস তার নিজের সত্যতা প্রমাণ করতে পারে না এবং অনুভূতি-উপলব্ধিও নিশ্চিত প্রমাণে পৌঁছাতে পারে না, সেহেতু সত্য বিশ্বাস অর্জনের জন্য বোধের সাথে দরকার ইচ্ছা ও কাজ। উদাহরণ দিলে পরিষ্কার হবে। এক মরুচারী দূরে পানি দেখল, সূর্যের আলো পৃথিবির বায়ুমণ্ডল বা তার চোখ কোনটাতেই দোষ নাই, সুতরাং পানি আসলেই আছে, কিন্তু তবুও মরীচিকা দেখার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে মরুচারী তার দেখাকে সন্দেহ করতে পারে। এই সন্দেহ দূর করে সত্য বিশ্বাসে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় পানির কাছে পৌঁছানোর ‘ইচ্ছা’ পোষণ করা, আর পৌঁছায়ে পানিতে ডুব দেয়া ও পানি খাওয়ার ‘কাজ’ করা। ইচ্ছা ও কাজের পরে যদি তার তৃষ্ণা ও উষ্ণতা কমে তবেই বুঝা যাবে পানি আছে। এই ইচ্ছা ও কাজকে ন্যায় মতে বলা হয় ‘সংবাদী প্রবৃত্তি’ অর্থাৎ যে ইচ্ছার মধ্যে বিসংবাদ নাই। এখানে সংবাদটা কিসের মধ্যে? প্রত্যক্ষণ ও প্রবৃত্তির মধ্যে, প্রথমে মরুচারী পানিটা শুধু প্রত্যক্ষ করছিল, দেখছিল, কিন্তু তার সাথে যদি পানি সম্পর্কে তার অন্যান্য বিশ্বাস না মিলে তবে সত্য বিশ্বাস আসবে না। পানি শুধু চোখে দেখলে হবে চেখেও দেখতে হবে পানি দেখার বর্তমান অভিজ্ঞতা তার সব অতীত বিশ্বাসের সাথে মিলতেছে কি না। এটা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাথে খুব যায়। বিজ্ঞানেও একটা নতুন ধারণাকে সেই বিজ্ঞানের অন্য সব ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হয়।
[২৬] ধর্মের বিধিনিষেধ কিভাবে প্রমাণ করা যায়? শব্দ অর্থাৎ অথরিটির মাধ্যমে। ধর্মের কিতাবকে তুলনা করা হইছে আয়ুর্বেদের প্রেস্ক্রিপশনের সাথে। ঈশ্বর ডাক্তারের মতো অব্যর্থ অথরিটি। ডাক্তারের কথা শুনলে ঈশ্বরের কথাও শুনতে হবে। কিন্তু ঈশ্বর যে অব্যর্থ সেটা আমরা কিভাবে জানি? তাও শব্দের মাধ্যমে। এখানে একটা সার্কুলার লজিক আছে। কিন্তু লজিক যতই ভুল হোক মনে রাখতে হবে যেকোনো তর্ক মীমাংসার জন্য নৈয়ায়িকরা শেষ পর্যন্ত তাদের সর্বজনীন প্রাকৃত তত্ত্ববিদ্যাই প্রয়োগ করতেছেন, দেকার্তের মতো ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার ভিতরে খোদার উপস্থিতি খুঁজতেছেন না।
[২৭] নৈয়ায়িকদের তন্ত্রকে বড় ঝামেলায় ফেলছিলেন বৌদ্ধ মাধ্যমিকরা। নাগার্জুনের মধ্যমক ধারায় বলা হইছে, নৈয়ায়িকদের ‘প্রমাণ’ হয় অনন্ত প্রত্যাবৃত্তি নয় বৃত্তীয় পর্যাবৃত্তি তৈরি করে। এক প্রমাণকে আরেক প্রমাণ দিয়ে ন্যায্য প্রমাণ করার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে অনন্ত প্রত্যাবৃত্তি, ইনফিনিট রিগ্রেস। আর প্রমার গুণের মাধ্যমে প্রমাণ প্রমাণ করতে চাওয়ার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে বৃত্তীয় পর্যাবৃত্তি, সার্কুলার লজিক। যেমন, একটা বোধ প্রমা কারণ তার প্রমাণ আছে, আর এই প্রমাণ ন্যায্য কারণ এর মাধ্যমে সব সময় এই প্রমা তৈরি করা গেছে; মনে হচ্ছে সার্কুলার। নৈয়ায়িকরা এতে পিছপা হন নাই, কারণ তাদের মতে প্রমা একটা না, চার চারটা, একটা ব্যর্থ হলে আরেকটা প্রয়োগ করা যায়। আর আধুনিক বিজ্ঞানে আসলে সার্কুলারিটি কোনো সমস্যা না। প্রকৃতির মধ্যে পর্যাবৃত্তি কাঁথার মধ্যে সুতার মতো গাঁথা। বৃত্তের পরিধি বরাবর চার কেন বরং হাজার রকম ভাবে ঘুরতে ঘুরতেই বৈজ্ঞানিক তথ্য দিন দিন একটু একটু করে সত্য হতে থাকে, তবে কখনোই পুরা সত্য হয় না কারণ সত্য পরিধিতে নাই, আছে কেন্দ্রে।
[২৮] নৈতিক প্রকৃতিবাদ দুইটা ধারণার উপর দাঁড়ায়ে আছে: এক, সব নৈতিক তথ্যই প্রাকৃতিক, দুই, নৈতিক তথ্য ভৌত জগতকে ও মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। ভারতে এই দুইটাই পাওয়া যায়। শুরু করতে হয় কর্ম ও ফল দিয়ে, বা কর্মফল দিয়ে। মানুষের প্রতিটা কর্মের ফল আছে, ভালো কর্ম ভালো ফল দেয়, খারাপ কর্ম খারাপ ফল দেয়। প্রত্যেকে শুধু তার নিজের কর্মের জন্য দায়ী, এক জনের কর্মের ফল অন্য জন ভোগ করে না। বর্তমান কাজ অতীতের কাজ দিয়ে নির্ধারিত, তার পরও বর্তমানের প্রতিটা কাজ মানুষ স্বাধীনভাবে করে এবং তার ফল ভবিষ্যতে ভোগ করতে হবে। নির্ধারিত কর্ম কিভাবে স্বাধীন হয়ে ফল দিতে পারে তার চেয়েও বড় একটা সমস্যা এই তত্ত্বে আছে: কর্মের ফল যদি থেকেই থাকে তবে আমরা ভালো মানুষকে খারাপ আর খারাপ মানুষকে ভালো থাকতে দেখি কেন? এটা সমাধানের জন্য কর্মের সাথে পুনর্জন্ম যোগ করা হইছে। প্রত্যেক অবস্থার যেহেতু কারণ আছে সেহেতু বর্তমান জীবনে কেউ ভালো থাকার অর্থ আগের জীবনে সে ভালো কিছু করছিল, আর বর্তমান জীবনে খারাপ থাকার কারণ আগের জীবনের খারাপ কাজ। পুনর্জন্মের কেউ দেখে নাই, কিন্তু কর্মের সাথে পুনর্জন্ম যোগ করলে মহাবিশ্বের সবকিছুকে আসলেই যুক্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। সবকিছু এক কসমিক নিয়ম মেনে চলতেছে মনে হয়। গ্রিকরা যেমন বিশ্বের নিয়মানুবর্তিতা বুঝাইতে কসমস ব্যবহার করত ভারতে তেমন ইউজ করা হইত ঋত, যা থেকে ঋতু শব্দটা আসছে। ঋত মানে নিয়মানুবর্তী বিশ্বের সার্বিক নিয়ম, ঋতের বিপরীত করাই পাপ। এমনকি দেবতারাও ঋতের বিপরীত করতে পারে না, বেদান্তে ঋতের আরেক নাম ব্রহ্ম।
[২৯] কর্ম তিন ধরনের: প্রারব্ধ সঞ্চীয়মান সঞ্চিত। যে-কর্ম ইতিমধ্যে ফল দেয়া শুরু করে দিছে এবং যাকে মাঝপথে থামানো সম্ভব না তার নাম প্রারব্ধ কর্ম। সঞ্চীয়মান কর্ম এখন করা হইতেছে কিন্তু ফল পাওয়া যাবে ভবিষ্যতে। আর সঞ্চিত কর্ম ইতিমধ্যে করা হয়ে গেছে তবে তার ফল এখনো পাওয়া যায় নাই। কর্মকে তিরের সাথে তুলনা করা যায়। ধনুক থেকে বাইর হয়ে পড়া তির প্রারব্ধ কর্মের মতো, যে-তির তিরন্দাজ ধনুকে লাগায়ে ছিলা বাঁকায়ে ছুঁড়তে উদ্যত তা হলো সঞ্চীয়মান, আর যেসব তির তূণীরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে সেগুলা সঞ্চিত কর্ম। তির যেখানে বিঁধবে যা ঘটাবে তাই ফল, ঠেকানোর উপায় নাই। ভৌত বিশ্বের সব পরিণাম যেমন কারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়, নৈতিক বিশ্বের সব ফল তেমনি কর্ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। মেথডের দিক দিয়ে দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নাই।
[৩০] মীমাংসক দার্শনিকরা কর্ম সমর্থন করলেও তা প্রাকৃতিকভাবে ব্যাখ্যা করেন নাই। মীমাংসা মতে দুইটা নৈমিত্তিক জাহান আছে, প্রাকৃতিক ও আচারিক। আচারিক জাহানের বিধিবিধান প্রাকৃতিক জাহান থেকে পুরাপুরি আলাদা, একটা আরেকটার উপর নির্ভর করে না। একটা আচার থেকে ফল কিভাবে আসে তা প্রাকৃতিক মেথডে কখনোই ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। পুত্রেষ্টি যজ্ঞ থেকে কিভাবে পুত্র পাওয়া যায় তা আচারিক জাহানের ব্যাপার, প্রাকৃতিক জাহানের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আওতার বাইরে। নৈয়ায়িকরা অবশ্য প্রাকৃতিকই থেকে গেছেন। তারা এমনকি কর্মকে তাদের পরমাণুবাদের সাথে মিলানোর চেষ্টা করছেন, যদিও তাতে তাদের সাত্ত্বিক প্রকৃতিবাদ কিছুটা আহত হইছে। মানুষ তার কর্মের ফল কেবলমাত্র দৈহিক জীবনেই পেতে পারে, বিদেহী অবস্থায় পায় না। তার মানে অতীতের সব কর্ম একসাথে অনেক পরমাণুকে এমন ধরনের গতি দিতে পারে যার ফলে বর্তমান জীবন তৈরি হয়। অর্থাৎ ন্যায় দর্শনে পরমাণুর চালিকাশক্তি কর্ম। এখানে পরমাণুকে যতই অদৃশ্য শক্তির দাস করা হোক, শেষ পর্যন্ত এটাকে সারা বিশ্বের ‘এক’ সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা হিসাবেই দেখতে হয়। এখানে স্বয়ং বিশ্বের সৃষ্টিকে নৈতিক হিসাবে দেখা হচ্ছে। কর্ম আর অদৃষ্ট মিলে বিশ্বকে বারবার নতুন রূপে তৈরি করতেছে, পুনর্জন্ম শুধু মানুষের হচ্ছে না, হচ্ছে সারা মহাবিশ্বের।
Based on ‘Naturalism in Classical Indian Philosophy,’ Amita Chatterjee, Stanford Encyclopedia of Philosophy.