Abekta

Nothing human is alien to me

User Tools

Site Tools


৩. তারা যুগ

সক্রেটিস: গ্যালাক্টিক যুগে আমরা দুইটা ব্যাপার বুঝার সময় পাইনি। প্রথমত, গ্যালাক্সি কিভাবে এলিপ্টিকেল থেকে লেন্টিকুলার হয়, মানে একটা গোল জিনিস কিভাবে ফ্ল্যাট হয়। দ্বিতীয়ত, গ্যালাক্সির ডিস্কের মধ্যে কিভাবে স্পাইরাল আর্মের জন্ম হয়। স্টেলার যুগেই যেহেতু এসব ঘটনা ঘটেছে সেহেতু আশাকরি যুদ্ধের দেবতা মার্স এই দুই ব্যাপার পরিষ্কার করে আমাদেরকে শান্তি দিবে।

মার্স: যুদ্ধের পরে শান্তি আসবে। কিন্তু আপাতত যুদ্ধ ছাড়া গতি নাই। দেখো সামনে বিরাট ইয়ারলুং-সাংপো গর্জ, পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘ গিরিখাত। এই গর্জের কানফাটা গর্জনের কারণে তো আমরা কেউ কারো কথা শুনতেই পারব না।

হার্মিস: আমরা তোমার কথা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি। ‘ক্রাউচিং টাইগার, হিডেন ড্রাগন’ সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো এক লাফে নামছা বারওয়া’র চূড়া থেকে চলো সবাই গর্জের একদম নিচে। সেখানেই সব শব্দের মধ্যে ভাসাব আমাদের কথার শব্দ।

[সবাই পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফ দেয় নিচে, এক মুহূর্তে চলে আসে ৭ কিমি নিচে সিয়াং নদীর তীরে।]

1. জন্মহার ও মৃত্যুহার

সক্রেটিস: ইউনিভার্সের সাত যুগ যেভাবে ভাগ করা হয়েছে তা নিয়ে আমার কনফিউশন আছে। প্ল্যানেটারি থেকে কালচারাল পর্যন্ত চার যুগের সময়সীমা যে পৃথিবী ও মানুষের সাপেক্ষে করা হয়েছে তা বুঝেছি। কিন্তু স্টেলার যুগ আমরা ঠিক দশ বিলিয়ন বছর আগে থেকে শুরু করলাম কেন? প্রথম গ্যালাক্সির জন্ম যখন হয়েছে প্রথম তারাদের জন্মও তখন হয়েছে। তাহলে স্টেলার যুগকে গ্যালাক্টিক যুগের পরে নিয়ে আসার কারণ কি?

মার্স: এই প্রশ্ন উঠবে জেনেই এই ফিগার আগে থেকে রেডি করে রেখেছি। এখানে দেখা যাচ্ছে কালো ও লাল রঙের দুইটা কার্ভ গত বারো বিলিয়ন বছরের মধ্যে প্রায় সব সময় খুব কাছাকাছি ছিল। কালো কার্ভটি হচ্ছে স্টার ফর্মেশন রেট (এসএফআর), আর লালটি ব্ল্যাক হোল এক্রিশন রেট (বিএইচএআর)। এক্স অক্ষে আছে উপরে সময়, নিচে রেডশিফট; আমরা গ্যালাক্টিক যুগেই জেনেছি রেডশিফট সময়ের প্রক্সি। ওয়াই অক্ষে আছে দুইটা রেট। ফর্মেশন রেটটা এক ধরনের জন্মহার। এর মাধ্যমে জানা যায় মহাবিশ্বের ইতিহাসের যেকোনো সময়ে এক বিলিয়ন (গিগা) কিউবিক লাইট-ইয়ার ভলিউমের মধ্যে যত তারার জন্ম হচ্ছিল তাদের মোট ভর সূর্যের কত গুণ। এক্রিশন রেটটা এক ধরনের মৃত্যুহার। এর মাধ্যমে জানা যায় সেই একই সময়ে এক বিলিয়ন কিউবিক লাইট-ইয়ারের মধ্যে সূর্যের কত গুণ ভরের পদার্থ ব্ল্যাকহোলের ভিতর হারিয়ে যাচ্ছিল।

সক্রেটিস: তা বুঝলাম, ফিগারটা এখন পড়া যাচ্ছে। এও বুঝতে পারছি যে দুইটা কার্ভই ১০ বিলিয়ন বছর আগে সবচেয়ে উঁচু বিন্দুতে পৌঁছেছিল।

মার্স: মানে দশ বিলিয়ন বছর আগে গ্যাস থেকে সবচেয়ে বেশি তারা জন্মাচ্ছিল, এবং একইসাথে সবচেয়ে বেশি তারা ও গ্যাস ব্ল্যাকহোলের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছিল। যখন জন্মের হার সবচেয়ে বেশি তখন মৃত্যুর হারও সবচেয়ে বেশি, যদি ব্ল্যাকহোলের ভিতরে হারিয়ে যাওয়াকে আমরা অন্তত রূপকার্থে হলেও মৃত্যু হিসেবে গণ্য করি।

সক্রেটিস: এর সাথে মানুষের জনসংখ্যার তুলনাও করা যায়। নাইজার, চাদ ও কঙ্গোতে জন্মহার যেমন বেশি, মৃত্যুহারও তেমন বেশি। অবশ্য মানুষের সমাজ যেকোনো ফিজিকেল সিস্টেমের চেয়ে বেশি জটিল হওয়াতে তুলনাটা অত সোজা হবে না।


মার্স: সোজা না হলেও বেশ মজার। যেমন গ্যাপমাইন্ডার দিয়ে বানানো এই ভিডিওতে গত প্রায় দুইশ বছরে পৃথিবীর সব দেশের নারী-প্রতি-সন্তান ও জন-প্রতি-জিডিপি’র পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। প্রতিটা বাবল একটা দেশ, বাবলের সাইজ জনসংখ্যার সমানুপাতিক। বর্তমানে যে-দেশে সন্তান কম সে-দেশের জিডিপি বেশি। জন্মহার ও মৃত্যুহার তুলনা করে একটা দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হিসাব করা যায়। তারাদের জন্মহার যেমন দশ বিলিয়ন বছর আগে সবচেয়ে বেশি ছিল, তেমনি দেখা যাচ্ছে ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত বাংলাদেশে পরিবার-প্রতি সন্তানের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল, ছয়ের বেশি। এখন আনুমানিক দুই।

সক্রেটিস: মহাবিশ্বের সাথে মানুষের তুলনা সব সময়ই মজার। তবে এক তারার সাথে আরেক তারার তুলনা এখন বেশি করা দরকার। আমার তো সব তারা দেখতে একই রকম লাগে, সব তারাই গোল, গ্যাসের বিশাল গোলক। তাহলে তারাদের শ্রেণিবিন্যাস কিভাবে করা হয়?

2. তারার শ্রেণিবিন্যাস

মার্স: মনে হচ্ছে তোমার ডিমন তোমাকে আগে থেকেই জানিয়ে দেয় আমাদের আলোচনার পরের টপিক। এখন ঠিক তারার ক্লাসিফিকেশন নিয়েই কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

সক্রেটিস: আমার ডিমনের এত আজাইরা সময় নাই। যাহোক, তোমার ক্লাসিফিকেশন শুনি আগে।

মার্স: গ্যালাক্সিদের শ্রেণিবিন্যাস করা হয় তাদের আকৃতির মাধ্যমে, কারণ তাদের আকৃতিতে আসলেই অনেক বৈচিত্র্য আছে। তারা সব যেহেতু দেখতে একই রকম গোল, সেহেতু ‘আকৃতি’র বদলে এদের শ্রেণিবিন্যাস করা হয় ‘আকার’ দিয়ে। যে তারার আকার যত বেশি, অর্থাৎ যে তারা যত বড়, তার ভর ও তাপমাত্রাও তত বেশি। সুতরাং আকার, ভর ও তাপমাত্রা তিনটাই শ্রেণিবিন্যাসে সমানভাবে ইউজ করা যায়। এই ছবিতে ও থেকে এম পর্যন্ত ৭ ধরনের তারা দেখানো হয়েছে। সূর্যের চেয়ে আনুমানিক ৫০ গুণ ভারী তারারা হলো ও-টাইপ তারা। এদের সার্ফেস টেম্পারেচার প্রায় ৪০ হাজার কেলভিন, আর গড় আয়ু (লাইফটাইম) মাত্র ১০ মিলিয়ন বছর। সূর্য একটা জি-টাইপ তারা, এর সার্ফেস টেম্পারেচার মাত্র ৫ হাজার কেলভিন, আর আয়ু প্রায় ১০ বিলিয়ন বছর। এম-টাইপ তারাদের ভর সূর্যের মাত্র ২০%, আর আয়ু প্রায় ১০০ বিলিয়ন বছর।

সক্রেটিস: তার মানে এ পর্যন্ত যত এম-টাইপ বা কে-টাইপ তারার জন্ম হয়েছে তাদের কোনোটাই মারা যায়নি?

মার্স: না। মহাবিশ্বে এই সব ছোট তারাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। একটা দেশে ধনীর চেয়ে গরিবের সংখ্যাও কিন্তু অনেক বেশি হয়।

সক্রেটিস: ভালো তুলনা। তাহলে আমাদের সূর্য ধনী না গরিব?

মার্স: মিডল-ক্লাস বলতে হবে। পার্থক্যটা রঙের মধ্যেও ধরা পড়ে।

ইশ্তার: হ্যাঁ, ছোট তারারা একটু লাল, আর বড়রা একটু নীল। কিন্তু হোয়ার্লপুল গ্যালাক্সিতে যাওয়ার পথে আকাশগঙ্গা পার হওয়ার সময় তো আমাদের কাছে সব তারাই দেখতে সাদা মনে হচ্ছিল।

মার্স: তারা দেখতে সাধারণত সাদাই। এখানে বুঝানোর জন্য রংটা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারা দেখতে সাদা কারণ সে সব রঙের আলোই দেয়, সব রং একসাথে মিশালে সাদা রং পাওয়া যায়। তার মানে এই না যে সব তারা থেকে সব রং একই হারে বের হয়। বড় তারারা লালের চেয়ে নীল রঙের আলো বেশি তৈরি করে, ছোট তারারা নীলের চেয়ে লাল রঙের আলো বেশি বানায়, আর সূর্যের মতো মাঝারি তারারা লাল ও নীলের মাঝখানের সবুজ আলো বেশি দেয়। সূর্য থেকে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আসে সবুজ আলো।

সক্রেটিস: তারার সাইজ বেশি হলে ভর ও তাপমাত্রাও বেশি হয়, কিন্তু এসবের সাথে রঙের কি সম্পর্ক?

মার্স: পার্টিকেল যুগেই আমরা দেখেছি যে রং মানে কম্পাঙ্ক। নীল রঙের আলোর কম্পাঙ্ক বেশি, সবুজের একটু কম, লালের আরো কম। কম্পাঙ্ক আবার সরাসরি এনার্জির সাথে সম্পর্কিত। যে তারার তাপমাত্রা বেশি তার এনার্জিও বেশি, কারণ টেম্পারেচার আসলে তারার সব গ্যাস-কণার গড় এনার্জির পরিমাপক। আর যে তারার এনার্জি যত বেশি সে তত বেশি কম্পাঙ্কের আলো দিতে পারে। এজন্যই ও-টাইপ তারারা এত নীল, জি-টাইপ তারারা এত সবুজ, আর এম-টাইপ তারারা এত লাল।

সক্রেটিস: খালি চোখে দেখতে যদি সবাইকেই সাদা দেখায় তাহলে রঙের পার্থক্য কিভাবে বুঝা সম্ভব?

মার্স: খালি চোখে সম্ভব না। কিন্তু টেলিস্কোপের ফোকাল প্লেইনে বসানো প্রিজমের মতো বিভিন্ন ধরনের স্পেক্ট্রোগ্রাফ দিয়ে আলোকে বিভিন্ন কম্পাঙ্ক বা রঙে ভাগ কর যায়। তার পর দেখা যায় কোন তারা থেকে কোন রঙের আলো সবচেয়ে বেশি আসছে। আসলে এইভাবে আলোর বর্ণালি বিশ্লেষণের মাধ্যমেই একটা তারার টেম্পারেচার মাপা হয়।

জুনো: আচ্ছা, বুঝলাম যে এই কারণেই তুমি তারার ‘সার্ফেস’ টেম্পারেচারের কথা বলছ। যে-আলোর রং দিয়ে তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে সেই আলো তারার সার্ফেস থেকে আসে। অতএব সার্ফেসের তাপমাত্রাই সহজে বের করা সম্ভব। কিন্তু তারার ভিতরের তাপমাত্রা জানার কি কোনোই উপায় নেই?

মার্স: আছে। স্টেলার স্ট্রাকচারের কিছু ইকুয়েশন আছে। এগুলো দিয়ে কম্পিউটারে তারা সিমুলেট করা যায়। আর এই সিমুলেশনের রেজাল্ট থেকে তারার সার্ফেস থেকে একেবারে সেন্টার পর্যন্ত তাপমাত্রা, ঘনত্ব, প্রেসার, ইত্যাদি সব জানা যায়।

সক্রেটিস: এখন কিন্তু তোমার আয়ুর ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করা উচিত। আকার, ভর ও তাপমাত্রা বেশি হলে আয়ু কম হচ্ছে কেন?

মার্স: আবারো পরের টপিকে যেতে বাধ্য করছ। সহজ উত্তর হচ্ছে, যে তারা যত বড় সে তত তাড়াতাড়ি তার জ্বালানি শেষ করে ফেলে, তাই তত তাড়াতাড়ি মারা যায়।

সক্রেটিস: জ্বালানি মানে?

3. তারার জন্ম

মার্স: তারা কেন তাড়াতাড়ি মারা যায় সেটা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হবে তারার জন্ম কিভাবে হয়। এই ছবিতে জন্মের প্রসেসটা দেখানো হয়েছে। গ্যালাক্সির ভিতরে ইন্টারস্টেলার মিডিয়ামে গ্যাস ও ডাস্টের অনেক ক্লাউড থাকে এবং এসব মেঘ থেকেই তারার জন্ম হয়। এখানে প্রায় আড়াইশ লাইট-ইয়ার সাইজের একটা বিশাল মেঘ দেখানো হয়েছে; মনে রাখতে হবে একটা সোলার সিস্টেমের সাইজ মাত্র এক লাইট ইয়ার। আশপাশের প্রভাবে নিজের কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরতে থাকা এই বিশাল মেঘের ভর ও সাইজ যখন একটা নির্দিষ্ট মানের (জিন্স ভর) বেশি হয়ে যায়, তখন সেলফ-গ্র্যাভিটির কারণে মেঘটা তার নিজের কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত হতে শুরু করে। সংকোচনের সময় বড় মেঘটা অনেকগুলো ছোট ছোট মেঘে বিভক্ত হয়ে যায়। এই রকম ছোট একটা ক্লাউডের অবস্থা কয়েক মিলিয়ন বছর পরে কেমন হবে সেটাই মাঝের প্যানেলে দেখানো হয়েছে।

জুনো: আগে ছিল রূপহীন মেঘ, এখন দেখি মাঝখানে লাল-লাল একটা গোলক, আর তার চারদিকে আধা লাইট-ইয়ার সাইজের একটা ফ্ল্যাট ডিস্ক। নিরাকার মেঘ থেকে গোল কোর আর ফ্ল্যাট ডিস্ক কিভাবে তৈরি হলো এই কয়েক মিলিয়ন বছরে?

মার্স: এটা বুঝতে হলে গ্র্যাভিটি ও রোটেশনের পার্থক্যটা বুঝতে হবে। আমি যদি এই পাথরের উপর থেকে সিয়াং নদীর তুখোড় স্রোতে লাফ দেই, এখন আমার কিছুই হবে না, কিন্তু বেঁচে থাকলে মারা যেতাম। কারণ গ্র্যাভিটি আমাকে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে টানছে। কোনো এস্ট্রোনট পৃথিবীর যত কাছে আসে পৃথিবীর গ্র্যাভিটি তাকে তত জোরে টানে। তার মানে গ্র্যাভিটি সব সময় আকর্ষণ করে, এবং গ্র্যাভিটির কেন্দ্রের যত কাছে যাব গ্র্যাভিটি ততই বাড়বে।

জুনো: এখন রোটেশন বুঝানোর জন্যই কি দড়ির এক প্রান্তে পাথরের টুকরা বাঁধলে?

মার্স: হ্যাঁ। দড়ির এই প্রান্ত ধরে যদি আমি পাথরটা ঘুরাতে থাকি আমার চারপাশে, তাহলে হাতের উপর একটা কেন্দ্রবিমুখী বল অনুভব করব। দড়িটা এই ছেড়ে দিলাম। পাথরটার কি হয়েছে?

জুনো: পাথরটা ছিটকে গিয়ে আংসিতে পড়েছে।

মার্স: তার মানে গ্র্যাভিটির বিপরীতে রোটেশন হচ্ছে বিকর্ষণমুখী। এখন এই দেখো আরো বড় একটা দড়ি নিয়ে একই সাইজের আরেকটা পাথর ঘুরিয়ে ছেড়ে দিলাম। পাথরটা কত দূর গেলো?

জুনো: প্রথমটা যত দূর গিয়েছিল তার চেয়ে বেশি।

মার্স: তার মানে এইবার কেন্দ্রবিমুখী বলটা আরো বেশি ছিল। অর্থাৎ রোটেশনের কেন্দ্র থেকে যত দূরে যাওয়া হয়, রোটেশনের প্রভাব তত বাড়ে, যা গ্র্যাভিটির বিপরীত। তার মানে দাঁড়াচ্ছে কেন্দ্রের কাছে রোটেশনকে হারিয়ে গ্র্যাভিটি জিতে যায়। আর গ্র্যাভিটি যেহেতু পুরাপুরি সিমেট্রিক, মানে সব দিকে সমান হারে আকর্ষণ করে, সেহেতু গ্র্যাভিটির প্রভাবে কোরটা হয়ে যায় গোল। আর এই গোলকের বাইরে কেন্দ্র থেকে দূরত্ব যেহেতু বেশি, সেহেতু গ্র্যাভিটিকে হারিয়ে রোটেশন জিতে যায়, এবং সেই কারণেই একটা ফ্ল্যাট ডিস্ক তৈরি হয়। কেন্দ্রের কাছে গ্র্যাভিটি সবচেয়ে শক্তিশালী হওয়ায় বেশির ভাগ পদার্থ কেন্দ্রে তারার ভিতরে চলে যায়, মাত্র ১ পার্সেন্টের মতো অবশিষ্ট থাকে ডিস্কে।

জুনো: তার মানে গ্র্যাভিটির যেমন একটা স্ফেরিকেল সিমেট্রি আছে, তেমন রোটেশনের আছে সার্কুলার সিমেট্রি?

মার্স: খুব সুন্দরভাবে বলে দিলে। ঠিক তাই। রোটেশনের সার্কুলার সিমেট্রি কাজ করে রোটেশনের এক্সিসের লম্ব বরাবর। একটা গোল পিৎজা ডো নিয়ে যদি আমি হাতের উপর রেখে ঘুরাতে থাকি তাহলে গোল ডো-টা ফ্ল্যাট ডিস্ক হয়ে যাবে, এখানে আমার হাতটাই ঘূর্ণনের এক্সিস, ডিস্কটা যার লম্ব।

সক্রেটিস: আচ্ছা বুঝলাম। আধা লাইট-ইয়ার সাইজের এই গোল কোর ও ফ্ল্যাট ডিস্ক থেকে এর পরে প্রোটোস্টারের জন্ম কিভাবে হয় সেটা বলো।


মার্স: এই ভিডিওতে আরো ভালো করে দেখানো হয়েছে। এখানে ওরায়ন কনস্টেলেশনে থাকা বিশাল ওরায়ন মলিকুলার ক্লাউড কমপ্লেক্সের ভিতরে জন্মাতে থাকা অনেক তারার সত্যকার ছবি দেখানো হয়েছে। প্রক্রিয়াটা এমন। মাঝের গ্যাসের গোলকটা যখন যথেষ্ট বড় হয় তখন ডিস্ক থেকে গ্যাস-ডাস্ট খাওয়া শুরু করে। ঘুরতে থাকা গ্যাসের গোলকের ভিতরে ঢুকতে থাকা গ্যাস-ডাস্টের কিছু অংশ ছিটকে চলে যায় উপরে ও নিচে, রোটেশনের এক্সিস বরাবর। এই কারণে গ্যাস-গোলকের দুই মেরু থেকে গ্যাস-ডাস্টের দুইটা জেট বের হয় যাদের গালভরা নাম বাইপোলার আউটফ্লো। এর সাথে গ্যালাক্টিক যুগে দেখা এক্টিভ গ্যালাক্সির নিশ্চয়ই মিল পাচ্ছ!

সক্রেটিস: শুধু যে আউটফ্লোতে মিল পাচ্ছি তা না, আমার কাছে তারার জন্মের পুরা প্রক্রিয়াটাই একটা লেন্টিকুলার বা স্পাইরাল গ্যালাক্সির জন্মের মতো মনে হচ্ছে।

মার্স: হ্যাঁ, স্টেলার সিস্টেমের মতোই এসব গ্যালাক্সি ফ্ল্যাট। গ্যালাক্সির ডিস্কও অনেকটা একইভাবে ঘুরতে-থাকা ইন্টারস্টেলার ক্লাউড থেকে তৈরি হয়, তবে এক্ষেত্রে ক্লাউডের সাইজ অনেক বড়। স্টার বা স্টেলার সিস্টেম বানানো ক্লাউড যদি কয়েকশ লাইট-ইয়ার সাইজের হয়, তবে গ্যালাক্সি বানানো ক্লাউডের সাইজ হবে কয়েক লাখ বা মিলিয়ন লাইট ইয়ার।

সক্রেটিস: এক্টিভ গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা ব্ল্যাকহোল যেমন এক সময় তারা-গ্যাসের অভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, তেমনি কি এই প্রোটোস্টারের বাইপোলার আউটফ্লোও এক সময় ফুরিয়ে যাবে?

মার্স: হ্যাঁ, এবং ঠিক তখনি গ্যাস-গোলকটা তার টিনেজ পেরিয়ে একটা এডাল্ট তারায় রূপান্তরিত হবে।

সক্রেটিস: ঠিক কখন একটা গ্যাস-গোলককে প্রোটোস্টার না বলে এডাল্ট তারা বলা যায়?

মার্স: এর জন্য সূর্যের মতো তারার ভিতরের স্ট্রাকচারের এই ছবিটা বুঝতে হবে। এসব তারার কেন্দ্রে থাকে একটা কোর, তার বাইরে রেডিয়েটিভ জোন, তার বাইরে কনভেক্টিভ জোন, তার পর ফটোস্ফিয়ার মানে তারার দৃশ্যমান সার্ফেস। ফটোস্ফিয়ারের বাইরে একটা ক্রোমোস্ফিয়ার ও করোনা থাকে যা দেখা যায় শুধু টোটাল এক্লিপ্সের সময়। মানুষকে তখনি এডাল্ট বলা হয় যখন তার সাইজ আর বাড়ে না, মানে সে আর লম্বা হয় না, একটা স্টেবল অবস্থায় পৌঁছায়, আঠার বছর বয়সের পরে। তেমনি একটা তারাও তখনি এডাল্ট যখন তার সাইজ আর খুব একটা পাল্টায় না।

সক্রেটিস: তো এখানে লাল, নীল, সবুজ তির দিয়ে কি এই স্টেবিলিটি তৈরির উপায়টাই বুঝাচ্ছ?

মার্স: হ্যাঁ। সবুজ তির দিয়ে কেন্দ্রমুখী সেলফ-গ্র্যাভিটি বুঝানো হচ্ছে। তারার সব দিকের সব গ্যাস গ্র্যাভিটির কারণের কেন্দ্রের দিকে যেতে চায়, মানে তারাটিকে সংকুচিত করতে চায়। কিন্তু তারা যত ছোট হয় তার গ্যাস তত গরম হয়, আর গ্যাস যত গরম হয় ততই বাইরের দিকে একটা কেন্দ্রবিমুখী বল প্রয়োগ করে। লাল তির দিয়ে এই গ্যাস প্রেসার বুঝানো হয়েছে। গ্র্যাভিটি ও গ্যাস প্রেসার যদি সমান হয় তাহলে তারা আর গ্র্যাভিটির কারণে ছোটও হবে না, গ্যাস প্রেসারের কারণে বড়ও হবে না। কিন্তু গ্যাস প্রেসার আসলে গ্র্যাভিটির চেয়ে একটু দুর্বল, তাই যেকোনো তারা স্থির রাখার জন্য গ্যাস প্রেসারের পাশাপাশি আরেকটা কেন্দ্রবিমুখী প্রেসার লাগে। এই সহযোগী প্রেসারের নাম নিউক্লিয়ার প্রেসার, যা কেন্দ্র থেকে নীল তির দিয়ে দেখানো হয়েছে।

সক্রেটিস: নিউক্লিয়ার প্রেসার নাম কি এই কারণে যে এই প্রেসারের জন্ম হয় নিউক্লিয়ার রিয়েকশনের মাধ্যমে?

মার্স: ঠিক তাই। গ্র্যাভিটির চেয়ে গ্যাস প্রেসার বেশি হওয়ায় প্রোটোস্টার যত সংকুচিত হয় তার গ্যাস তত আরো গরম হয়। সবচেয়ে বেশী গরম হয় কেন্দ্রের কাছের গ্যাস, মানে কোরের গ্যাস। কোরের তাপমাত্রা যখন ১৫ মিলিয়ন ডিগ্রিতে পৌঁছায় তখনি শুরু হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া।

সক্রেটিস: কার সাথে কার ফিউশন?

মার্স: ইউনিভার্সের মোট পদার্থের ৭৬ শতাংশই যেহেতু হাইড্রোজেন সেহেতু তারার মধ্যেও ৭৫% গ্যাস হয় হাইড্রোজেন গ্যাস। পনের মিলিয়ন ডিগ্রিতে কোরের হাইড্রোজেনের সাথে হাইড্রোজেনের ফিউশন শুরু হয়, মানে দুইটা হাইড্রোজেন এটম মিলিত হয়ে একটা হিলিয়াম এটম তৈরি করে। আসলে এটম না, তৈরি করে এটমের নিউক্লিয়াস। তাপমাত্রা অনেক বেশি হওয়ায় নিউক্লিয়াসের চারদিকে কোনো ইলেক্ট্রন জমাট বাঁধতে পারে না, নিউক্লিয়াস নিঃসঙ্গই থেকে যায়।

সক্রেটিস: হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হয় বুঝলাম, পার্টিকেল যুগে আমরা এই প্রক্রিয়া আরো বিস্তারিতভাবে দেখেছি, ডায়াগ্রাম সহ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফিউশনের কারণে কোর থেকে কেন্দ্রবিমুখী নিউক্লিয়ার প্রেসার কিভাবে জাগে?

মার্স: নিউক্লিয়ার ফিউশনের সময় প্রচুর এনার্জি তৈরি হয় আলো হিসাবে। এই আলো যখন তারার কোর থেকে সার্ফেসের দিকে যেতে শুরু করে তখন তাদের কারণে একটা রেডিয়েশন প্রেসারের জন্ম হয়। এটাকেই আমরা নিউক্লিয়ার প্রেসার বলেছি। ফিউশন শুরু হওয়ার পরেই নিক্লিয়ার প্রেসার গ্যাস প্রেসারের সাথে মিলে গ্র্যাভিটিকে মোকাবেলা করে, এবং তারা আর ছোট বা বড় হয় না, স্টেবল থাকে। তখনি আমরা একটা তারাকে এডাল্ট তারা বলতে পারি।

4. তারার জীবন

হার্মিস: আমরা যেহেতু ভারত ও চীনের বর্ডারে চলে এসেছি, চলো বিশিং গ্রামের সেই বিখ্যাত বৌদ্ধ বিহারে বসে তারার জীবনের কাহিনি শুনি। কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে ভারত ও চীনের সীমান্ত-সৈনিকদের নাটক দেখতেও খারাপ লাগবে না।

[আংসির তীর ছেড়ে সবাই বিশিং গ্রামের বিহারে বসেছে সাদাচূড়া সব পাহাড়ের দিকে মুখ করে।]

মার্স: তারার জীবন বুঝতে হলে এইচ-আর ডায়াগ্রাম নামে পরিচিত এই বিখ্যাত প্লট বুঝতে হবে। এটাই তারার জীবনের প্লট, লিটারেলি কাহিনি। এই ডায়াগ্রামের এক্স অক্ষে (হরিজন্টাল) আছে তারার সার্ফেস টেম্পারেচার, ডানে মাত্র ১ হাজার কেলভিন থেকে শুরু করে বামে একেবারে ১ লাখ ডিগ্রি পর্যন্ত। আর ওয়াই অক্ষে (ভার্টিকেল) লুমিনসিটি, মানে ওয়াটে একটা তারার পাওয়ার, যার সাথে আমরা লাইট-বাল্বের পাওয়ার বা উজ্জ্বলতার তুলনা করেছি গ্যালাক্টিক যুগেই। তাপমাত্রা কেলভিনে দেয়া হলেও লুমিনসিটি (উজ্জ্বলতা) দেয়া আছে সূর্যের সাপেক্ষে, ১ মানে সূর্যের সমান, তার উপরে সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল ১ মিলিয়ন গুণ পর্যন্ত, আর নিচে সূর্যের চেয়ে অনুজ্জ্বল ১০ হাজার গুণ পর্যন্ত। আর প্রতিটা ক্রস চিহ্ন একটা তারার পজিশন। যেকোনো ক্রস থেকে সোজা নিচে গেলে সেই তারার তাপমাত্রা জানা যাবে, আর সোজা বামে গেলে পাওয়া যাবে তার পাওয়ার বা উজ্জ্বলতা। উপরের হরিজন্টাল এক্সিসে কিন্তু তারার সেই শ্রেণিবিন্যাসও দেখানো হয়েছে। আগে আমরা এম-টাইপ পর্যন্ত দেখেছিলাম, এখানে আরো কম তাপমাত্রার এল-টাইপ ও টি-টাইপ তারাও যোগ করা হয়েছে। আলোর বর্ণালি দিয়ে তাপমাত্রা মাপা হয় বলে এই সব টাইপের নাম স্পেক্ট্রাল ক্লাস। বামে নিচের কোণায় একটা ডায়াগোনাল তীর চিহ্ন দিয়ে বুঝানো হচ্ছে এই তীর বরাবর যত উপরে যাব তারার সাইজ তত বাড়বে, আর নিচে কমবে।

সক্রেটিস: বেশির ভাগ তারা (মানে ক্রস) মনে হচ্ছে একটা ডায়াগোনাল (কোণাকোণি) ব্যান্ডের মধ্যে, যেখানে একটা হলুদ ও একটা নীল রেখা এসেছে এবং আবার বের হয়েছে, হলুদ ও নীল রেখার মধ্যে তীর চিহ্নের কারণে আসা-যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝা যাচ্ছে। এই ডায়াগোনাল ব্যান্ড আর এই দুই রঙিন রেখার অর্থ কি?

মার্স: এই ব্যান্ডের নাম মেইন সিকোয়েন্স, এডাল্ট তারারা সব এখানেই থাকে। আর রঙিন রেখা দুইটা দুই টাইপের তারার জীবনের রেখা, যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তারার টেম্পারেচার ও লুমিনসিটির পরিবর্তন দেখায়। নীল রেখাটা সূর্যের চেয়ে দশ-বিশ গুণ ভারী বড় তারার জন্য, আর হলুদ রেখাটা সূর্যের মতো ছোট তারার জন্য।

সক্রেটিস: মেইন সিকোয়েন্সের ডান দিকে বা বাম দিকে কি কোনো এডাল্ট তারা পাওয়া যায় না?

মার্স: না। তারার তাপমাত্রা (এক্স) যত বাড়বে উজ্জ্বলতাও (ওয়াই) তত বাড়বে। এজন্যই মেইন সিকোয়েন্সটা ডায়াগোনাল। এর ডানে থাকা মানে তারার তাপমাত্রা কম কিন্তু উজ্জ্বলতা বেশি, আর বামে থাকা মানে তাপমাত্রা বেশি কিন্তু উজ্জ্বলতা কম, এই দুই ক্ষেত্রেই তারা ছোট বা বড় হতে থাকে, স্টেবল থাকে না। স্টেবিলিটি পাওয়া যায় শুধু মেইন সিকোয়েন্সে। তারার শ্রেণিবিন্যাস দেখানোর সময় আমি যে আয়ুর কথা বলেছিলাম, তা আসলে বুঝায় একটা তারা মেইন সিকোয়েন্সে কতদিন থাকতে পারে। সূর্য মেইন সিকোয়েন্সে দশ বিলিয়ন বছর থাকতে পারবে, পাঁচ বিলিয়ন বছর পার হয়ে গেছে, আছে আরো পাঁচ বিলিয়ন বছর।

সক্রেটিস: ছোট তারার জীবনরেখা ধরে যাও এখন, মানে এই এইচ-আর ডায়াগ্রামের হলুদ রেখাটা বুঝাও।

মার্স: এইচ-আর ডায়াগ্রামের হলুদ রেখার সাথে এই ছবি মিলিয়ে দেখলে সহজে বুঝা যাবে। এই ছবিতে সূর্যের মতো ছোট তারার জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটা স্টেজ ছবি দিয়ে বুঝানো হয়েছে, আর সেই হলুদ রেখা প্রত্যেক স্টেজে তারাটার তাপমাত্রা ও উজ্জ্বলতা সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে। আমি ব্রাউজারে দুইটা পাশাপাশি রেখে বুঝাচ্ছি। হলুদ রেখা দেখাচ্ছে, শুরুতে প্রোটোস্টার বানানো ক্লাউড ছিল ঠাণ্ডা; ১০০০ কেলভিন থেকে বামে যেতে যেতে মেঘের তাপমাত্রা যখন ৪০০০ কেলভিন হয়, তখনি রেখাটা হঠাৎ নিচে নামতে শুরু করে, মানে মেঘটা সংকুচিত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে নিচে নামা মানে ব্রাইটনেস (পাওয়ার) ও সাইজ কমা। প্রোটোস্টার ও বাইপোলার আউটফ্লো ধাপ পেরিয়ে তারা যখন আরো সংকুচিত হয় ও তার কোরে নিউক্রিয়ার ফিউশন শুরু হয় তখন হলুদ রেখাটা মেইন সিকোয়েন্সে পৌঁছায়, মানে তারাটা স্টেবল এডাল্ট হয়। এখানে সূর্যের মতো তারারা দশ বিলিয়ন বছর থাকে, কারণ কোরে যত হাইড্রোজেন আছে সব হিলিয়ামে কনভার্ট করতে এত বছর লাগে। দশ বিলিয়ন বছর পর যখন হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যায় তখন কি হয় বলতে পারবে?

সক্রেটিস: আচ্ছা জ্বালানি নিয়ে আমি আগে যে প্রশ্ন করেছিলাম তার উত্তর পেলাম। হাইড্রোজেনই তারার জ্বালানি, নিউক্লিয়ার রিয়েকশনের জ্বালানি। শেষ হয়ে গেলে কেন্দ্রবিমুখী নিক্লিয়ার প্রেসার থাকবে না, গ্র্যাভিটি তারাকে আবার সংকুচিত করবে।

মার্স: আর তারা ছোট হলে কি হবে?

সক্রেটিস: অবশ্যই গ্যাস আরো গরম হবে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, তারা সংকুচিত হলে তো মেইন সিকোয়েন্স থেকে আরো নিচের দিকে যাওয়ার কথা, তাহলে মৃত্যুর পথে হলুদ রেখাটা মেইন সিকোয়েন্স থেকে উপরের দিকে যাচ্ছে কেন?

মার্স: কারণ, সক্রেটিস, গ্যাস যখন অনেক গরম হয় তখন কোরের চারদিকে একটা শেলের মধ্যে হাইড্রোজেন ফিউশন শুরু হয়ে যায়। শেল যেহেতু কোরের তুলনায় সার্ফেসের অনেক কাছে, সেহেতু শেলে তৈরি নিউক্লিয়ার প্রেসারের কারণে তারাটা অনেক প্রসারিত হয়ে রেড জায়ান্টে পরিণত হয়। রেড কারণ তার তাপমাত্রা বেশ কম। এই রেড জায়ান্ট হলুদ রেখা ধরে উপরে একটা সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছানোর পর শেলের ভিতরে কোর এত গরম হয় যে কোরে হিলিয়াম ফিউশন শুরু হয়, মানে দুইটা হিলিয়াম মিলিত হয়ে কার্বন বানানো শুরু করে। তখন হলুদ রেখাটা আবার নিচে নেমে একটা বিন্দুতে থিতু হয়। এই স্টেজে তারাটাকে আমরা ইয়েলো জায়ান্ট ডাকি। এখন হিলিয়াম জ্বালানিও যদি শেষ হয়ে যায়, মানে সব হিলিয়াম যদি কার্বনে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তাহলে কি হবে?

সক্রেটিস: অবশ্যই তারা আগের মতোই শেলের ফিউশনের কারণে আবার উপরে উঠবে, মানে প্রসারিত হবে। ছবিতে এটাকে সেকেন্ড রেড জায়ান্ট অবস্থা বলা হয়েছে।

মার্স: তারার কার্বন-কোরটা প্রসারিত হবে না, কোরের চারদিকের গ্যাস প্রসারিত হতে হতে অনেক দূরে চলে যাবে। তখন কেন্দ্রে ঘন তারার চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো রঙিন গ্যাসের একটা বলয় দেখা যায়। এর নাম প্ল্যানেটারি নেবুলা। আমাদের স্মার্ট টেলিস্কোপ দিয়ে অনেক সুন্দর প্ল্যানেটারি নেবুলার ছবি তোলা যায়। হেলিক্স ও ডাম্বেল নেবুলার ছবি অনেককেই মুগ্ধ করে। নিশা আসলে আমরাও এদের ছবি তুলে দেখতে পারি। যাই হোক, এই প্ল্যানেটারি নেবুলার বাইরের গ্যাস এক সময় ইন্টারস্টেলার ক্লাউডে মিলিয়ে যায়, আর কোরটা আরো ছোট ও গরম হতে থাকে, ফলে হলুদ রেখা বাম দিকে যায়। নেবুলা পুরা মিলিয়ে যাওয়ার পর কোরটা ধীরে ধীরে আরো ছোট ও ঠাণ্ডা হয়ে এক সময় হোয়াইট ডোয়ার্ফে পরিণত হয়। সূর্যের মতো তারাদের ডেডবডি হচ্ছে হোয়াইট ডোয়ার্ফ।

সক্রেটিস: চমৎকার। তার মানে তারা মেঘ থেকে আসে, আবার মেঘেই মিলিয়ে যায়। বাইবেলে আমরা যেখান থেকে আসি সেখানেই ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে যে জোর দেয়া হয়েছে তা এখন নতুনভাবে অনুভব করতে পারছি।

মার্স: একদম ঠিক। তারার জীবন মানুষের জীবনের মতোই এক ধরনের সাইক্লিক প্রসেস। আমরা মাটি থেকে এসে মাটিতে মিলাই, তারারা গ্যাস থেকে এসে গ্যাসেই মিলায়। বড় তারাদের জীবনের এই ছবির সাথে উপরের এইচ-আর ডায়াগ্রামের নীল রেখাটা মিলালে বড় তারাদের ক্ষেত্রেও এই চাক্রিক প্রক্রিয়া দেখতে পাবে।

সক্রেটিস: কালকে বলেছিল বড় তারা বলতে তুমি সূর্যের চেয়ে ৮ গুণ বা তার চেয়ে ভারী সব তারাকে বুঝাচ্ছ। আচ্ছা এদের কাহিনি এখন বলো।

মার্স: এইচ-আর ডায়াগ্রামে দেখো, নীল রেখা নিচ থেকে উপরের দিকে গিয়ে মেইন সিকোয়েন্সে মিলিত হয়। মানে গ্যাস ধীরে ধীরে গরম ও প্রসারিত হয়, তাপমাত্রা ২০ হাজার ডিগ্রির বেশি হলে গ্যাসের সংকোচনের মাধ্যমে একই রকম প্রোটোস্টার ও আউটফ্লো ধাপ পেরিয়ে এডাল্ট মেইন-সিকোয়েন্স তারার জন্ম হয়। মৃত্যুর সময় হলে মেইন-সিকোয়েন্স থেকে প্রায় সোজা ডান দিকে বের হয় নীল রেখা, মানে তাপমাত্রা কমে ও সাইজ কিছুটা বাড়ে, এই ধাপের নাম ব্লু জায়ান্ট। এর পর আসে পালসেটিং ইয়েলো জায়ান্ট ধাপ, মানে তারার সাইজ ক্রমান্বয়ে বাড়ে ও কমে। আরো প্রসারিত হলে আমরা পাই রেড সুপারজায়ান্ট। এক্ষেত্রে তারার কোরে কার্বন থেকে অক্সিজেন হয়ে আরো ভারী অনেক মৌল তৈরি হয়। কোরটা যখন পুরা লোহার (নিউক্লিয়াসে ২৬টা প্রোটন) হয়ে যায় তখন আর ফিউশন চলতে পারে না। তখন গ্র্যাভিটির প্রভাবে তারার কোর এক সেকেন্ডের মধ্যে ভয়ানকভাবে কলাপ্স করে। কেন্দ্রের দিকে ধ্বসে পড়তে থাকা কোর যখন লোহার কোরে পৌঁছায় তখন আর কেন্দ্রের দিকে যেতে পারে না, বরং লোহার কোর থেকে বাউন্স করে এক বিরাট বিস্ফোরণের সাথে চারদিকে ছিটকে পড়ে। এরই নাম সুপারনোভা।

সক্রেটিস: এই বিস্ফোরণে নিশ্চয়ই কোরের চারদিকের সব গ্যাসও ছিটকে পড়ে, এবং ছোট তারার গ্যাসের মতোই আবার তাদের জন্মস্থান মানে ইন্টারস্টেলার ক্লাউডে মিলিয়ে যায়। কিন্তু লোহার কোরটার কি হয়?

মার্স: লোহার কোর আরো সংকুচিত হয়ে নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়। সূর্যের চেয়ে দশ-বিশ গুণ ভারী তারার কোর সাধারণত নিউট্রন তারা হয়, আর তার চেয়েও ভারী তারাদের শেষ ঠিকানা হয় ব্ল্যাক হোল।

সক্রেটিস: আমরা তাহলে তারার তিন ধরনের ডেডবডির কথা শুনলাম: ছোট তারার ক্ষেত্রে হোয়াইট ডোয়ার্ফ, আর বড় তারার ক্ষেত্রে নিউট্রন স্টার বা ব্ল্যাক হোল। কবর খুঁড়ে বেদনা জাগানো ভালো না জানি, তবু আমি নিশ্চিত আমাদের সবারই জানতে ইচ্ছা করছে এই তিন লাশের শরীর আসলে কেমন।

5. তারার মৃত্যু

মার্স: তারার লাশ তার জীবনের চেয়ে কম ইন্টারেস্টিং না। প্রথমে হোয়াইট ডোয়ার্ফ বুঝার জন্য আমাদের উচিত ১৬০৪ সালে ফিরে গিয়ে প্রাগে কেপলারের সাথে দেখা করা। সেই বছর কেপলার একটা সুপারনোভা দেখেছিলেন, যাকে আমরা এখন ‘কেপলারের সুপারনোভা’ ডাকি, যার রেমনেন্ট এখন আমাদের থেকে ২০ হাজার লাইট দূরে। চন্দ্র এক্স-রে অব্জার্ভেটরি এর ছবি তুলে দেখেছে, বিস্ফোরণের কারণে তার গ্যাস ৪০০ বছর পর এখনো ঘণ্টায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন কিমি বেগে বাইরের দিকে ছুটছে। কিন্তু এটা আমি আগে যে-সুপারনোভার কথা বলেছি সেরকম না, এটা অত বড় তারা থেকে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছে ছোট তারা থেকে।

সক্রেটিস: ছোট তারা থেকে তো বললে শুধু হোয়াইট ডোয়ার্ফ হয়, সুপারনোভা হয় না।

হার্মিস: সবুর করো। আগে চলো ১৬০৪ সালের প্রাগে।

[হার্মিসের সাহায্যে সবাই ১৬০৪ সালের এক রাতে প্রাগে গিয়ে বাজারের রাস্তায় কেপলারকে দেখতে পায়; সে তিন জনের সাথে হালকা তর্ক করছে।]

মার্স: তোমরা অদৃশ্যই থাকো। আমি কেপলারের সাথে কথা বলি দেখা দিয়ে।

[কেপলার যে তিন জনের সাথে তর্ক করছিল মার্স তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, বাকি সাত জন অদৃশ্য থেকে সব দেখে ও শোনে।]

কেপলার: আমি নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করব না যে আকাশে একটা নতুন তারা দেখা গেছে। বিশ্বাস অবশ্যই করতে চাই, কারণ এটা এরিস্টটলের তত্ত্বকে আরেকটা বড় ধাক্কা দিবে।

মার্স: আমি কিন্তু গতকালই দেখেছি নিজের চোখে।

কেপলার: কোন দিকে?

মার্স: ঐ যে ঐ দিকে তাকাও, এখনো দেখা যাচ্ছে। তোমার চার্টে দেখো ওখানে ঐ তারাটা এখন থাকার কথা কি না।

কেপলার: অসাধারণ। আসলেই নতুন তারা। এটা এখানে থাকার কথা না। গতকাল রাত থেকে দেখা যাচ্ছে। এরিস্টটল বলেছিলেন মহাকাশে নতুন কিছু ঘটে না। তিনি ভুল প্রমাণিত হলেন। আমার কাজ এখন কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্ব প্রমাণ করে এরিস্টটলকে কবর দেয়ার কাজটা ঠিকভাবে শেষ করা।

মার্স: এই নতুন তারাও যে এক ধরনের কবর, জানো?

কেপলার: মানে? তুমি কে? ফিলোসফার?

মার্স: আমি কে সেটা জানার দরকার নাই। আগে বলো প্লেটোর টিমেয়াসের মতো আমি যদি এই ‘নতুন’ তারা নিয়ে একটা সম্ভাব্য গল্প বলতে পারি তাহলে মন দিয়ে শুনবে?

কেপলার: আমি ‘সমনিয়াম’ নামে একটা গল্প নিজেই লেখার চিন্তা করছি, গল্পের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা নাই।

5.1 হোয়াইট ডোয়ার্ফ

মার্স: শোনো তাহলে। এই তথাকথিত ‘নতুন তারা’ আসলে একটা বাইনারি সিস্টেমে ছিল, মানে তার একটা সঙ্গী তারা ছিল। নতুন তারাটাকে ‘বি’ ডাকি, আর তার সঙ্গীকে ‘সি’। বি ও সি প্রায় দশ বিলিয়ন বছর ধরে একে অপরের চারদিকে ঘুরেছে। কিন্তু বি’র ভর ও সাইজ সি’র চেয়ে একটু বেশি হওয়াতে সে ১ কোটি বছর আগে মারা গিয়েছিল। মারা যাওয়ার পর তার লাশ একটা হোয়াইট ডোয়ার্ফে পরিণত হয়, মানে সাইজে খুব ছোট, কিন্তু টেম্পারেচার এত বেশি যে দেখতে সাদা। বি’র লাশের চারদিকে এক কোটি বছর ধরে ঘোরার পর সি’রও মরার সময় হয় এবং সে ফুলে ফেঁপে একটা বিশাল রেড জায়ান্টে পরিণত হয়, মানে সাইজে অনেক বড়, কিন্তু তাপমাত্রা এত কম যে দেখতে লাল। তার সাইজ এত বেড়ে যায় যে বি’র লাশ (হোয়াইট ডোয়ার্ফ) সি’র শরীর (রেড জায়ান্ট) থেকে গ্যাস শুঁষে নিতে শুরু করে। এর ফলে বি’র ভর বাড়তে বাড়তে গতকাল সূর্যের ভরের দেড় গুণের বেশি হয়ে যায় এবং বি তার কেন্দ্রের দিকে ধ্বসে পড়তে শুরু করে। কিন্তু কোরটা অনেক কঠিন হওয়াতে গ্যাস কেন্দ্র পর্যন্ত যেতে পারেনি, কঠিন কোরে ধাক্কা খেয়ে চারদিকে ছিটকে পড়েছে এক বিশাল বিস্ফোরণের সাথে। এজন্যই বি-কে এখন দেখা যাচ্ছে। বি আসলে ‘নতুন’ তারা না, একটা পুরানো তারার লাশের নতুন বিস্ফোরণ।

কেপলার: হয়ত সঙ্গী সি চাচ্ছে বি-কে আবার জাগিয়ে তুলতে।

মার্স: তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। এজন্যই বলি, মৃতকে কখনো জাগানোর চেষ্টা করতে নেই। অর্ফিয়াস যেখানে ইউরিডাইসকে ফেরাতে পারেনি সেখানে সি কিভাবে বি-কে ফিরাবে। বাস্তবে যা হয়েছে তা হলো বি’র বিশাল বিস্ফোরণে সি চিরতরে তাদের যৌথ অর্বিট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সি এখন একটা রানএওয়ে স্টার, পলাতক তারা, দলছুট তারা। তারা আর কোনোদিন একে অপরকে গ্র্যাভিটির বন্ধনে বাঁধতে পারবে না।

কেপলার: মৃতকে জাগানো যায় না সেটা ঠিক না। প্লেটো সক্রেটিসকে জাগিয়েছেন। আমি টাইকো ব্রাহিকে যতই অপছন্দ করি তার অব্জার্ভেশনের অর্থ কবর খুঁড়ে হলেও উদ্ধার করতে হবে।

[কেপলার ফিরে দেখে মার্স নেই; মুহূর্তে উধাও। হার্মিস সবাইকে নিয়ে ফিরে আসে ভারতে সিয়াং ও ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলে।]

সক্রেটিস: কাজটা কি ঠিক করলে? কেপলার বেচারা যদি এখন মার্সের অর্বিট বের করতে না পারে, সব দোষ তোমার।

মার্স: তোমার কি মনে হয় আমি এত সহজে ধরা দিব কেপলারে কাছে?

সক্রেটিস: তবে হোয়াইট ডোয়ার্ফের সুপারনোভা আমরা খুব ভালোভাবে বুঝেছি এই সুযোগে, গল্পের মতো গভীরভাবে। এবার বলো এই সাদা বামনের শরীর আসলে কি দিয়ে তৈরি?

মার্স: হোয়াইট ডোয়ার্ফ যেহেতু তারার অত্যন্ত সংকুচিত কোর, সেহেতু তার ডেন্সিটি অনেক বেশি। এত বেশি যে তার মধ্যকার ইলেক্ট্রনরা আর তাদের স্বাভাবিক অবস্থান ও বেগ বজায় রাখতে পারছে না। চাপাচাপি করতে করতে তারা একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে আসছে এবং তাদের বেগও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এদেরকে তাই বলা হয় ডিজেনারেট ইলেক্ট্রন। এরা আর কাছাকাছি আসতে চাইছে না বলে সবাই মিলে কেন্দ্রবিমুখী একটা প্রেসার তৈরি করছে যার নাম ডিজেনারেসি প্রেসার। এই প্রেসারই গ্র্যাভিটির বিরুদ্ধে হোয়াইট ডোয়ার্ফকে টিকিয়ে রাখতে পারে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর।

সক্রেটিস: আচ্ছা এখন বাকি দুই লাশের কথা বলো।

5.2 নিউট্রন স্টার

মার্স: কোনো তারার কোরের ভর যদি সূর্যের দেড় গুণের কম হয় তাহলে তা মৃত্যুর পর হোয়াইট ডোয়ার্ফ হবে, কিন্তু যদি দেড় গুণের বেশি হয় তাহলে হবে নিউট্রন স্টার। একটা তারার মোট ভর সূর্যের আট গুণ বা তার চেয়ে বেশি হলেই কেবল মৃত্যুর সময় তার কোরের ভর দেড় গুণের মতো হতে পারে। এই কারণে সূর্যের চেয়ে অন্তত আট গুণ ভারী তারাদের মৃতদেহই শুধু নিউট্রন স্টার হতে পারে।

সক্রেটিস: আগেও এই ‘দেড়’ গুণের কথা বলেছ। লিমিটটা সূর্যের ঠিক ‘দেড়’ গুণই কেন?

মার্স: সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর (‘চন্দ্র এক্স-রে অব্জার্ভেটরি’র নেমসেক) ১৯৩০ সালে কেম্ব্রিজ ইউনিতে যাওয়ার পথে মুম্বাই-টু-ভেনিসের এক জাহাজে বসে এই বিখ্যাত লিমিট আবিষ্কার করেছিলেন। ম্যাথ ছাড়া সব হয় মিথ নয় মিথ্যা, তবু ম্যাথ ছাড়াই ‘চন্দ্রশেখর লিমিট’ বুঝানোর চেষ্টা করছি, যার আসল মান ১.৪৪, মানে দেড়ের খুব কাছাকাছি। তারা মূলত হাইড্রোজেন (৭৪%) ও হিলিয়াম (২৪%) গ্যাস দিয়ে তৈরি। কিন্তু তারার ভিতরে তাপমাত্রা এত বেশি যে সব এটম থেকে ইলেক্ট্রন খসে যায়। ইলেক্ট্রনবিহীন এটমকে আয়ন বলে। স্বাধীন আয়ন ও ইলেক্ট্রনের গ্যাসকে বলে প্লাজমা। তাই তারাকে গ্যাসের বল না বলে প্লাজমার বল বলা উচিত। আর হাইড্রোজেন এটম যেহেতু শুধু একটা প্রোটন ও একটা ইলেক্ট্রন দিয়ে তৈরি, সেহেতু তারার প্লাজমা আসলে স্বাধীন প্রোটন ও ইলেক্ট্রনের গ্যাস, মানে তার মধ্যে আয়ন বলতে আছে শুধু বিচ্ছিন্ন প্রোটন। রেড জায়ান্ট ধাপ পার হওয়ার পরে তারার কোর যখন অনেক ছোট ও ঘন হয়ে যায়, তখন সব ইলেক্ট্রন ডিজেনারেট হয়ে গ্র্যাভিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, যার ফলে তৈরি হয় স্টেবল হোয়াইট ডোয়ার্ফ। কিন্তু চন্দ্রশেখর সেই জাহাজে বসে হিসাব করে দেখেছিলেন, কোরের ভর যদি সূর্যের দেড় গুণের বেশি হয়, তাহলে গ্র্যাভিটি এত শক্তিশালী হয়ে পড়ে যে ইলেক্ট্রনের ডিজেনারেসি প্রেসার আর গ্র্যাভিটিকে ঠেকাতে পারে না। ফলে তারা আরো ছোট ও ঘন হতে থাকে। আগে শুধু ইলেক্ট্রন চাপাচাপি করছিল, এইবার সব এটমের নিউক্লিয়াস ভেঙে যায়, এবং প্রোটন নিউট্রনে রূপান্তরিত হয়। এই সব নিউট্রনের অবস্থান ও বেগ (হোয়াইট ডোয়ার্ফের ইলেক্ট্রনের মতোই) অনেক অস্বাভাবিক হয়ে যায়, মানে তারা বেশি কাছাকাছি চলে আসে এবং তাদের বেগ অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে যায়। এর ফলে এবার নিউট্রনের ডিজেনারেসি প্রেসার তৈরি হয় যা গ্র্যাভিটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারাকে আরো সংকুচিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। নিউট্রন ডিজেনারেসি দিয়ে তৈরি এসব তারার নামই নিউট্রন স্টার।

সক্রেটিস: তা নিউট্রন স্টারের সাইজ কেমন হয়? নিশ্চয়ই খুব ছোট?

মার্স: হ্যাঁ। সূর্যের সমান একটা তারাকে (ব্যাস ১ মিলিয়ন কিমি) ছোট করে যদি প্রায় পৃথিবীর সমান (১০ হাজার কিমি) বানিয়ে ফেলি তাহলে পাওয়া যাবে হোয়াইট ডোয়ার্ফ, আর যদি আরো ছোট করে ঢাকা শহরের সমান (১০ কিমি) বানিয়ে ফেলি তাহলে হবে নিউট্রন স্টার। ভর যেহেতু কমাইনি সেহেতু ডেন্সিটি অনেক বেড়েছে। সূর্যের ভিতরে গ্যাসের ঘনত্ব প্রতি কিউবিক সেন্টিমিটারে (সিসি) মাত্র ১ গ্রাম, হোয়াইট ডোয়ার্ফে ১ মিলিয়ন গ্রাম, আর নিউট্রন স্টারে প্রায় ১০০০ ট্রিলিয়ন গ্রাম। এক চা-চামচে মোটামুটি এক সিসি পদার্থ উঠানো যায়। তার মানে নিউট্রন স্টারের এক চা-চামচ পদার্থের ভর ১ ট্রিলিয়ন কেজি। এবং নিউট্রন স্টারের চেয়ে গোল জিনিস মহাবিশ্বে আর কিছু সহজে পাওয়া যাবে না।

সক্রেটিস: কেন? সূর্যও তো গোল।

মার্স: সূর্যও গোল। পৃথিবীও গোল। কিন্তু কতটা গোল? একটু আগেই যেমন বললাম, রোটেশনের কারণে কেউ পুরাপুরি গোল থাকতে পারে না। পৃথিবী ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরে বলে মেরু (রোটেশনের এক্সিস) বরাবর একটু চ্যাপ্টা। পৃথিবীর ইকুয়েটরিয়াল ও পোলার ব্যাসের মধ্যে পার্থক্য ০.৩%, আর সূর্যের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য ০.০০০৯%, মানে সূর্য ৯৯.৯৯৯% পারফেক্ট গোলক। নিউট্রন স্টারও সূর্যের সমান গোল।

সক্রেটিস: এখন কিন্তু আমার মনে হচ্ছে নিউট্রন স্টার সূর্যের চেয়েও বেশি গোল হওয়া উচিত। কারণ সূর্যের চেয়ে নিউট্রন স্টারের ঘনত্ব অনেক বেশি, তার মানে সেলফ-গ্র্যাভিটিও অনেক বেশি।

মার্স: তুমি আজকে ফর্মে আছ মনে হচ্ছে, সক্রেটিস। হ্যাঁ গ্র্যাভিটি আসলেই অনেক বেশি। ওজন দিয়ে ব্যাপারটা বুঝানো যায়। পৃথিবীর সার্ফেসে ১০০ কেজি ভরের একজন মানুষের ওজন হবে ১ হাজার নিউটন, সূর্যের সার্ফেসে হবে ৩০ হাজার নিউটন, কিন্তু একটা নিউট্রন স্টারের সার্ফেসে তার ওজন হবে ১০০০ ট্রিলিয়ন নিউটন। ভরকে সার্ফেস গ্র্যাভিটি দিয়ে গুণ করলেই ওজন পাওয়া যায়। গ্র্যাভিটি এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও নিউট্রন স্টার সূর্যের সমান গোল, কারণ নিউট্রন স্টার ঘুরেও অনেক জোরে। এমন নিউট্রন স্টারও পাওয়া গেছে যারা এক সেকেন্ডে এক হাজার বার ঘুরে। এসব রোটেটিং নিউট্রন স্টারের আশপাশে যদি অন্য তারা বা গ্যাস থাকে তাহলে নিউট্রন স্টারের চারদিকে একটা এক্রিশন ডিস্ক তৈরি হয় এবং প্রোটোস্টার বা এক্টিভ গ্যালাক্সির মতোই ডিস্ক থেকে তার ভিতরে পদার্থ ঢুকতে থাকে। অনেক বেগে ঘোরার কারণে তখন কিছু পদার্থ দুই মেরু দিয়ে জেট হিসেবে বের হয়। এমন জেট থাকলে নিউট্রন স্টারটাকে বলা হয় পালসার।

সক্রেটিস: পালসের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে না কি?

মার্স: হ্যাঁ। এই ছবিতে যেমন দেখতে পাচ্ছ। পালসারের জেট যেহেতু একটা চিকন বিমের মধ্য দিয়ে যায়, সেহেতু আমরা কেবল তখনি জেটটা দেখতে পারি যখন তা সরাসরি আমাদের দিকে আসে। জেট আমাদের দিকে আসামাত্রই টেলিস্কোপে উচ্চ এনার্জির পালস পাওয়া যায়। এক সেকেন্ডে হাজার বার যারা ঘোরে তাদের কাছ থেকে আমরা এক সেকেন্ডে এক হাজার পালস পাই। প্রথম পালসার আবিষ্কার করেছিলেন কেম্ব্রিজে জসলিন বেল বার্নেল ১৯৬৭ সালে। এত নিখুঁত পালস দেখে অনেকে তখন এটাকে এলিয়েন সভ্যতার সিগ্নাল ভেবে ভুল করেছিল।

সক্রেটিস: এলিয়েন যে আসলেই আছে মানুষ মনে হয় সেটা জীবনেও বুঝবে না। যাই হোক, এখন ব্ল্যাক হোলের কথা বলো। আরো কত বড় তারা আর কত ঘন কোর লাগবে ব্ল্যাক হোল বানানোর জন্য?

5.3 ব্ল্যাক হোল

মার্স: ব্ল্যাক হোল কিভাবে হয় এখন তো বুঝতেই পারছ। তারার জীবনের মূল সমস্যা হলো গ্র্যাভিটির নিরন্তর কেন্দ্রমুখিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজেকে টিকিয়ে রাখা। সূর্য সেটা করে নিউক্লিয়ার প্রেসার ও গরম গ্যাসের প্রেসারের মাধ্যমে, হোয়াইট ডোয়ার্ফ করে ডিজেনারেট ইলেক্ট্রনের প্রেসার দিয়ে, আর নিউট্রন স্টার করে নিউট্রনের ডিজেনারেসি প্রেসার দিয়ে। কিন্তু শুরুতে একটা তারার ভর যদি সূর্যের ২০ গুণ বা আরো বেশি হয়, তাহলে মৃত্যুর সময় তার কোর সূর্যের দেড় গুণ না বরং অন্তত তিন গুণ ভারী হবে। এক্ষেত্রে নিউট্রনের দলও গ্র্যাভিটির কেন্দ্রমুখী চাপ আর ঠেকাতে পারবে না। কোরের বাইরের অংশ কলাপ্স করে ভিতরের অংশ থেকে যখন বাউন্স করবে তখন ভয়ানক শক্তিশালী সুপারনোভা বিস্ফোরণ হবে, যার নাম হাইপারনোভা। হাইপারনোভা বিস্ফোরণের পর কোরের একদম ভিতরের অংশটা গ্র্যাভিটির কারণে সংকুচিত হয়ে একটা প্রায়-শূন্য বিন্দু হয়ে যাবে, যেখানে ঘনত্ব অসীম।

সক্রেটিস: কিন্তু ব্ল্যাকহোল মানে তো একটা বিন্দু না। ব্ল্যাকহোলেরও তো সাইজ আছে।

মার্স: হ্যাঁ, আছে। এই ছবিতে একটা ব্ল্যাক হোলের মানচিত্র দেখতে পাচ্ছ। অন্তত ব্ল্যাকহোলের আশপাশের মানচিত্র। তার ভিতরের কিছু দেখানো সম্ভব না কারণ ভিতর থেকে এমনকি আলোও বের হতে পারে না।

সক্রেটিস: আলো বের হতে পারে না কি গ্র্যাভিটির জন্য?

মার্স: হ্যাঁ। যার সার্ফেস গ্র্যাভিটি যত বেশি তার গ্র্যাভিটি থেকে বের হওয়া তত কঠিন। পৃথিবীর মহাকর্ষ থেকে পালাতে হলে এক সেকেন্ডে যেতে হয় ১১ কিমি দূরে, সূর্য থেকে পালাতে হলে যেতে হয় ৬০০ কিমি, হোয়াইট ডোয়ার্ফ থেকে ৫ হাজার কিমি, নিউট্রন স্টার থেকে ১ লাখ কিমি দূরে। আলোর বেগ সেকেন্ডে ৩ লাখ কিমি, সুতরাং নিউট্রন স্টার থেকে বের হওয়ার সময় আলোও হিমশিম খায়, গ্র্যাভিটির টানে লম্বা হয়ে যায়। আর ব্ল্যাক হোল এমন জিনিস যার থেকে পালাতে হলে আলোর চেয়েও বেশি বেগ লাগে। আলো নিজেও পালাতে পারে না বলেই এদের নাম ব্ল্যাক হোল। সব এনার্জি-ম্যাটার কেন্দ্রের সিঙ্গুলারিটিতে থাকলেও ইভেন্ট হরাইজন পর্যন্ত ব্ল্যাক হোলের গ্র্যাভিটির প্রভাব থাকে, ইভেন্ট হরাইজনের ভিতরে ঢুকে গেলে আর বের হওয়া সম্ভব না। কারো পক্ষেই সম্ভব না। কারণ আলোর চেয়ে বেশি তো দূরের কথা, আলোর সমান বেগও কারো থাকতে পারে না। ইনারমোস্ট স্টেবল অর্বিটের চেয়ে কাছে যদি কিছু চলে যায় তাহলেই তার পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব না, ইভেন্ট হরাইজনে ঢুকে পড়াই তার একমাত্র ভাগ্য। এর ঠিক বাইরে আলো গ্র্যাভিটির কারণে এত বেঁকে যায় যে স্যাটেলাইটের মতো ব্ল্যাক হোলের চারদিকে ঘুরতে থাকে; এর ফলে একটা গোলাকার ফোটন স্ফিয়ার তৈরি হয়। এবং প্রোটোস্টার ও পালসারের মতোই ব্ল্যাক হোলের ভিতরে গ্যাস ঢুকে একটা সমতল এক্রিশন ডিস্ক থেকে। কিছু পদার্থ চিরতরে হারিয়ে যায়, আর রোটেশনের কারণে কিছু পদার্থ ব্ল্যাক হোলের দুই মেরু দিয়ে জেট হিসেবে বের হয় প্রায় আলোর সমান বেগে।

সক্রেটিস: আচ্ছা, এরকম অসংখ্য ব্ল্যাক হোলের সমন্বিত রূপই আমরা দেখেছিলাম গ্যালাক্টিক যুগে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল হিসেবে। কিন্তু সিঙ্গুলারিটিতে হারানো চলবে না এত তাড়াতাড়ি, ব্রহ্মপুত্র ডাকছে। পুরা মহাবিশ্ব পেরিয়ে আমাদের এখন যেতে হবে পৃথিবীতে, পাঁচ বিলিয়ন বছর আগে।

bn/courses/ast100/3.txt · Last modified: 2024/11/23 00:35 by asad

Donate Powered by PHP Valid HTML5 Valid CSS Driven by DokuWiki