এস্থেটিক্স
এস্থেটিক্স রুচির দর্শন। দর্শনের এই শাখার প্রশ্ন একটাই: মানুষের রুচি কিভাবে কিসের মাধ্যমে কিসের জন্য তৈরি হয়। এক সময় এস্থেটিক্স ব্যস্ত ছিল শুধুমাত্র আর্ট নিয়ে, এবং বিশেষ করে শিল্প কিভাবে সৌন্দর্যের অনুভূতি তৈরি করে তা নিয়ে, কিন্তু আমরা জানি আর্ট মানেই বিউটি না, আর এস্থেটিক অভিজ্ঞতা শুধু আর্ট না বরং আরো অনেক কিছু থেকে আসতে পারে, যেমন প্রকৃতি বা খোদা। ইংলিশে যাকে ‘দি এস্থেটিক’ বলা হয় বাংলায় তাকেই রুচি বলব। রুচি হতে পারে এক ধরনের জাজমেন্ট, এটিচুড, অভিজ্ঞতা (এক্সপেরিয়েন্স), কোয়ালিটি, অব্জেক্ট বা মূল্য (ভ্যালু)।
রুচি
প্রথমে রুচিকে জাজমেন্ট ভেবে শুরু করা যায়। ডেভিড হিউম ও তার সময়কার ব্রিটিশ অভিজ্ঞতাবাদীরা দাবি করেছিলেন, রুচি এক ধরনের অন্তঃস্থ ইন্দ্রিয় যা সব বহিঃস্থ ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভরশীল হলেও নিছক তাদের সমষ্টি না। বহিঃস্থ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে রুচি তার সব অব্জেক্ট পায়, কিন্তু তার পর নিজের মতো জাজমেন্ট তৈরি করে। হিউম, লর্ড শ্যাফটসবারি ও ফ্রান্সিস হাচিসন ভাবতেন রুচি ও নৈতিকতা একই অন্তঃস্থ ইন্দ্রিয়ের প্রডাক্ট। আমরা যেভাবে কোনোকিছু সুন্দর মনে করি সেভাবেই কোনো কাজকে মহৎ ভাবি। এবং রুচি ও নৈতিকতার অনুভূতি দুইটাই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে ‘সুখ’ দেয়। কান্ট রুচি থেকে আসা সুখ আর নৈতিকতা থেকে আসা সুখের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য দেখতে পান। নৈতিকতার সুখে স্বার্থ আছে, রুচির সুখে স্বার্থ নাই। কোনো কাজ নৈতিকভাবে ভালো ভাবার মধ্যে স্বার্থ আছে, কামনা আছে, কারণ আমরা সেই কাজ বাস্তবে আসলেই করতে বা করাতে চাই। কিন্তু কোনো মুভি বা মুরাল যদি রুচির দিক দিয়ে ভালো লাগে, তাহলে সেই ভালোর অনুভূতি থেকে শুধু সুখ নেয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। রুচি ভাবের ব্যাপার, নৈতিকতা ভবের। নিঃস্বার্থ সুখের মধ্যেই রুচির রস। রুচি বলে শুয়ে শুয়ে অনুভব করো, নৈতিকতা বলে উঠে গিয়ে কাজ করো। মনে হতে পারে, নিঃস্বার্থ সুখ দিয়ে রুচি ব্যাখ্যা করলে রুচির আর ‘মূল্য’ থাকে না। ঠিক না। সারাদিন কাজ করা আর সারা সন্ধ্যা ওয়াইন হাতে শুয়ে বসে মুভি দেখা দুয়েরই মূল্য আছে।
শোপেনহাওয়ার রুচিকে জাজমেন্ট হিসেবে না দেখে এটিচুড হিসেবে দেখেন। রুচির জাজমেন্ট না, ‘ধ্যান’ নিয়ে তিনি চিন্তিত। সুন্দর বা নান্দনিক কিছু দেখলে আমরা তা ভালো না খারাপ সেটা ইচ্ছা দিয়ে জাজ করি না, বরং নিজের ইচ্ছাকে পুরা বিসর্জন দিয়ে সেই জিনিসের নান্দনিকতায় গা ভাসাই, এভাবে ইচ্ছাহীন মনোযোগে ভেসে যাওয়ার নামই রুচির ধ্যান, এবং এই ধ্যানের মধ্যেই রুচির মূল্য, বাইরের আর কোনো মূল্যের দরকার নাই। জগতে টিকে থাকার জন্য আমরা সব সময় ইচ্ছার জাঁতাকলে পিষ্ট হই, সারাক্ষণ ইচ্ছাশক্তি দিয়ে কিছু না কিছু করতে হয়, রুচি আমাদেরকে ইচ্ছাসক্তি থেকে মুক্তি দেয়, কেবল রুচির সাগরে ভাসার সময়ই আমরা বিকৃতি ছাড়া বাস্তবতার আসল এসেন্স অনুভব করতে পারি, এখানেই রুচির মূল্য। কান্টের স্বার্থহীনতার সাথে শোপেনহাওয়ারের ইচ্ছাহীনতা তুলনা করলে রুচির ধারণা আরো স্পষ্ট হয়। জর্জ ডিকি এসব এটিচুড থিউরিকে এটাক করছেন এই বলে যে, বিশুদ্ধ মনোযোগ বা ধ্যান বলে কিছু নাই, এস্থেটিক জিনিস উপভোগ করার সময় কেউই পুরা ভেসে যেতে পারে না। ধরুন থিয়েটারে ‘ওথেলো’ চলছে; ডিকি বলেন, অডিয়েন্সের কেউই আসলে পুরা ভেসে যাচ্ছেন না, এক মা তার ছেলের অভিনয় দেখে গর্বিত, এক হাজব্যান্ড নিজের ওয়াইফের গোপন লাভারের কথা ভেবে জেলাস, এক মরালিস্ট নাটকের মরাল নিয়ে উদ্বিগ্ন, আর থিয়েটারের মালিক দর্শকের সংখ্যা নিয়ে চিন্তিত। আমি অবশ্য মনে করি একমাত্র মালিক বাদে বাকি সবাই আসলেই ভেসে আছেন, হতে পারে কেউ সাগরে কেউ নদীতে কেউ পুকুরে, কিন্তু সবাই ভাসছেন।
ক্লাইভ বেল শোপেনহাওয়ারের সাথে রুচির ধ্যানের ব্যাপারে একমত, কিন্তু তার মতে এই ধ্যানের মূল্য জীবনের জাঁতাকল থেকে মুক্তি বা বাস্তবতার আসল এসেন্স দেখার মধ্যে না, কারণ জীবন জাঁতাকল না এবং রুচির বস্তু (যেমন, আর্ট) আমাদেরকে বাস্তবতার কোনো এসেন্স আসলে দেখাতে পারে না। বেলের কাছে রুচির ধ্যানের মূল্য ‘আবেগের’ মধ্যে। আর্ট বা এস্থেটিক অন্য কিছু উপভোগ করার সময় আমাদের আবেগের সাগরে যেসব ঢেউ উঠে তা বেলের মতে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা। এম সি বিয়ার্ডসলি এই অভিজ্ঞতার বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমাদের জীবন অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত, জীবনের কোনো মাস্টারপ্ল্যান কাজ করে না, কোনো সার্বিক লজিক নাই, কিন্তু আর্টের মাধ্যমে একটা সম্পূর্ণ সৃষ্টি উপভোগের অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। একটা মুভি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা একক প্ল্যান অনুযায়ী চলে, পুরোটা একসাথে দর্শকের মনে একটা অখণ্ড অভিজ্ঞতা তৈরি করতে পারে। এই অভিজ্ঞতা মনোযোগ দিয়ে অর্জন করার মধ্যেই রুচির মূল্য। বিয়ার্ডসলির এই ব্যাখ্যা অবশ্য সব ধরনের এস্থেটিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে খাটে না। তাছাড়া ডিকি মনে করেন, আর্টের মধ্যে এসব গুণ থাকলেও আর্টের অভিজ্ঞতার মধ্যে সেসব গুণ নাও থাকতে পারে। বিয়ার্ডসলি পরে অভিজ্ঞতা থেকে সরে ক্লাইভ বেলের আরো কাছাকাছি গিয়ে রূপ বা ফর্মকে রুচির আসল অব্জেক্ট বলেছিলেন। এস্থেটিক জিনিসের অভিজ্ঞতা আসে তার রূপ থেকে।
রেফারেন্স
- দ্য রাটলেজ কম্পেনিয়ন টু এস্থেটিক্স, এডিশন ৩, রাটলেজ, ২০১৩।