অদৃশ্য আলোতে আকাশগঙ্গার অন্তর

পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো রেডিও দুরবিন দিয়ে তোলা হয়েছে আমাদের গ্যালাক্সি আকাশগঙ্গার এক অবিশ্বাস্য ছবি। রেডিও তরঙ্গ আমাদের চোখে ধরা দেয় না, তবে এই অদৃশ্য আলো দেখার ক্ষমতা আছে রেডিও টেলিস্কোপের, আর সেই দেখাকে মানুষের চোখের সামনে পরিচিত পোশাকে উপস্থিত করার উপায় জানে কম্পিউটার। টেলিস্কোপ ও কম্পিউটারের যোগসাজশে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র এই বার অদৃশ্য আলোতেই ধরা দিয়েছে অনবদ্য স্বচ্ছতা ও গভীরতার সাথে। দেখে মনে পড়ে শেকসপিয়রের সনেটের লাইন: ‘চোখ বন্ধ করলে আমি সবচেয়ে ভালো দেখি।’ দৃশ্য আলো দিয়ে মিল্কিওয়ের কেন্দ্র দেখা যায় না কেন্দ্র ঘিরে থাকা বিপুল পরিমাণ গ্যাসের কারণে। দেখতে হলে আশ্রয় নিতে হয় অদৃশ্য অবলোহিত আর রেডিও তরঙ্গের।

দক্ষিণ আফ্রিকার এস্ট্রোনমাররা সেই দেশের কারু মরুতে স্থাপিত মিয়ারক্যাট রেডিও দুরবিন দিয়ে আকাশগঙ্গার কেন্দ্র ও তার আশপাশে দুই ডিগ্রির মধ্যে (চাঁদ বা সূর্যের ব্যাস আধা ডিগ্রি) মোট বিশটা এলাকা আলাদা আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন সেই ২০১৮ সালে। পঁচিশ হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা লম্বা লম্বা সব তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ মিয়ারক্যাটের চৌষট্টিটা এন্টেনায় প্রতিফলিত হয়ে প্রতিটা ডিশের সাথে যুক্ত গ্রাহকযন্ত্রে ধরা পড়েছিল ভোল্টেজ হিসাবে। বিভিন্ন গ্রাহকযন্ত্রে রক্ষিত সব ভোল্টেজ গুণ করার দায়িত্ব ছিল কোরিলেটর নামে পরিচিত কিছু গুণক মেশিনের। গুণক থেকে বের হওয়া সব গুণফল সংরক্ষিত ছিল দানবীয় ক্ষমতার এক সুপারকম্পিউটারে। যার যার ল্যাপটপে বসে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ তিন বছর ধরে এই সব গুণফল ঘষেমেজে পরিষ্কার করার আদেশ দিয়ে গেছেন গণক সুপারকম্পিউটারকে। গুণফলের সীমাহীন ভুলত্রুটি ঘেটে গরম হলেও শেষ পর্যন্ত আদেশ শুনেছে গণক। হাজার ভেজালে জর্জরিত সব গুণফল থেকে গণকের গণনায় বের হয়ে এসেছে এযাবৎ মানুষের তোলা গ্যালাক্সিকেন্দ্রের সবচেয়ে সুন্দর ছবি। বিশটা পর্যবেক্ষণের ছবি পাশাপাশি বসায়ে যে মোজাইক ছবি বানানো হয়েছে তা দেখে প্রথমে জে এম ডব্লিউ টার্নারের পেইন্টিঙের কথা মনে করে কিছুক্ষণ থ মেরে থাকি, আর তারপর শুধু আফসোস হয় যে আমাদের নাই রেডিওচোখ। এই সেই ছবি।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চার আয়ান হেইউডের নেতৃত্বে পরিচালিত রেডিও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী দলের হাতে তিলে তিলে গড়ে উঠা এই ছবিতে গ্যালাক্সিকেন্দ্রের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অনেক অঞ্চল দেখা যাচ্ছে আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কারভাবে। আমরা পৃথিবীর আকাশে আমাদের চ্যাপ্টা গ্যালাক্সির তলকে এই রকম অনুভূমিকভাবে দেখি না, দেখি বাম দিকে বাঁকানো লম্বালম্বি এক শুভ্ররেখা হিসেবে। সৌন্দর্যের খাতিরে এখানে আসল উল্লম্ব ছবিটাকে ঘুরিয়ে অনুভূমিকভাবে দেখানো হয়েছে। আসল ছবিটা বের হয়েছিল অ্যাস্ট্রোফিজিকেল জার্নালে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। যেই এঙ্গেলেই দেখি না কেন, ছবির প্রতিটা পিক্সেলের মান আমাদেরকে সেইখান থেকে আসা রেডিও তরঙ্গের উজ্জ্বলতা জানায়। তবে ২০১৮ সালের মতো এইবার কেবল উজ্জ্বলতা মেপেই ক্ষান্ত ছিলেন না বিজ্ঞানীরা। প্রতিটা পিক্সেলে বর্ণালির তথ্য যোগ করে বানিয়েছেন আরেকটা ছবি যেখানে অনেক বস্তুর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কাঠামোও দেখা যাচ্ছে:

প্রথম ছবির পিক্সেল আর দ্বিতীয় ছবির ভোক্সেল আবারো বুঝিয়ে দিচ্ছে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে সূর্যের চেয়ে চল্লিশ লক্ষ গুণ ভারী ব্ল্যাকহোলটা যতই নিষ্ক্রিয় হোক তার আশপাশের এলাকাটি শান্ত না। দ্বিতীয় ছবিতে বিশেষ কয়েকটা জিনিস আমি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করে দিয়েছি: (১) আকাশগঙ্গার কেন্দ্র স্যাজিটারিয়াস-এ, (২) স্যাজিটারিয়াস-বি, (৩) স্যাজিটারিয়াস-সি, (৪) আর্ক, (৫) হার্প, (৬) সাপ, (৭) সুপারনোভা রেমনেন্ট (এসএনআর) জি০.৯+০.১, (৮) এসএনআর জি০.৮-০.৪, এবং (৯) এসএনআর জি৩৫৯.১-০.৫। এছাড়া সুতার মতো সরু লম্বা অনেক ফিলামেন্ট দেখা যাচ্ছে যাদের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। আমরা এখানে এই নয়টা অব্জেক্টের সাথে পরিচিত হব স্বল্প পরিসরে।

সুপারনোভা রেমনেন্ট

প্রথমেই তিনটা সুপারনোভা রেমনেন্ট (৭, ৮, ৯) নিয়ে কথা বলা যাক। মরণাপন্ন একটা তারা বিস্ফোরিত হওয়ার পর তার টগবগে গ্যাস সবদিকে ছিটকে পড়ে যে প্রসরমান গোলকাকার খোলস তৈরি করে তা-ই সুপারনোভা রেমনেন্ট বা অবশেষ। ইংলিশে সংক্ষেপে এস-এন-আর ডাকা হয়, আমরা এই ছবির তিনটা চিহ্নিত রেমনেন্টকে বাংলায় যথাক্রমে এসএনআর-৭, এসএনআর-৮ ও এসএনআর-৯ ডাকব। এসএনআর-৭-এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘এসএনআর জি০.৯+০.১’, অর্থাৎ এর অবস্থান আকাশগঙ্গার তল থেকে ০.১ ডিগ্রি উত্তরে এবং সূর্য থেকে গ্যালাক্সিকেন্দ্র বরাবর কাল্পনিক রেখাটি থেকে ০.৯ ডিগ্রি পূর্বে। বিজ্ঞানীরা আগেই জানতেন এসএনআর-৭-এর কেন্দ্রে একটা পালসার আছে এবং পালসারের ঝড় থেকে কেন্দ্র ঘিরে একটা নেবুলা তৈরি হয়েছে। খোলসের মাঝখানে তুলনামূলক উজ্জ্বল অংশটাই নেবুলা। মিয়ারক্যাটের ছবি প্রথমবারের মতো দেখিয়েছে এই নেবুলার ভিতরে জট পাকানো সুতার মতো অনেক কাঠামো। নেবুলা থেকে সবদিকে প্রবাহিত গ্যাস অথবা একদিকে নিক্ষিপ্ত জেট রেমনেন্টের উপরের (সামান্য বামে) দিকের একটা অংশ প্রায় ছিঁড়ে ফেলছে।

এই ছবিতে যে বর্ণালির তথ্য যোগ করা হয়েছে তা আগেই বলেছি। তবে ‘তথ্য’ বলতে কি বুঝাচ্ছি তা আরেকটু ভেঙে বলা দরকার। তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গের কম্পাঙ্কের সাথে উজ্জ্বলতা কত পরিবর্তিত হয় তা বুঝা যায় স্পেক্ট্রাল ইন্ডেক্স নামে একটা সংখ্যার মাধ্যমে। ইন্ডেক্স বেশি হলে এক কম্পাঙ্ক থেকে আরেক কম্পাঙ্কে উজ্জ্বলতা বেশি পাল্টায়, ইন্ডেক্স কম হলে কম পাল্টায়। ইন্ডেক্সের মান পজিটিভ হলে কম্পাঙ্ক বাড়ার সাথে-সাথে উজ্জ্বলতা বাড়ে, নেগেটিভ হলে কম্পাঙ্ক বাড়ার সাথে-সাথে উজ্জ্বলতা কমে, আর শূন্যের কাছাকাছি হলে কম্পাঙ্কের সাথে উজ্জ্বলতা খুব একটা পাল্টায় না, সব কম্পাঙ্কে মোটামুটি একই পরিমাণ তরঙ্গ পাওয়া যায়। এই ছবিতে নীল রঙ দিয়ে পজিটিভ, কমলা রঙ দিয়ে নেগেটিভ, আর সাদা-সবুজ-ধূসরের কাছাকাছি রঙ দিয়ে শূন্যের কাছাকাছি স্পেক্ট্রাল ইন্ডেক্স বুঝানো হয়েছে। এসএনআর-৭-এর ছবিতে ফিরে গেলে স্পষ্টই দেখা যাবে, কেন্দ্রের সাদাটে নেবুলাকে ঘিরে রেখেছে একটা কমলাভ খোলস। এই পার্থক্য কিন্তু প্রথম ছবিতে একেবারেই করা যেত না। দ্বিতীয় ছবি স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় উচ্চ নেগেটিভ ইন্ডেক্সের খোলসের ভিতরে নিম্ন (শূন্যের কাছাকাছি) ইন্ডেক্সের একটা নেবুলা আছে। পালসার-ঘেঁষা নেবুলা থেকে বাইরের খোলসকে আলাদা করার এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় আমাদের জানা নাই।

এবার দেখা যাক এসএনআর-৮-এর ছবি কি বলে। এটা আসলেই এসএনআর কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে; এটা এখনো এসএনআর ক্যান্ডিডেট। মিয়ারক্যাটের ছবিতে একে প্রথমবারের মতো এসএনআর মনে হচ্ছে, কিন্তু প্রমাণের জন্য তা যথেষ্ট না কারণ রেডিওতে এর উজ্জ্বলতা খুব কম এবং স্পেক্ট্রাল ইন্ডেক্সও পরিষ্কার না। কিন্তু এটা বিভিন্ন কম্পাঙ্কে তোলা ছবির মধ্যে মিল দেখার জন্য একটা ভালো উদাহরণ। আগেই বলেছি, আকাশগঙ্গার কেন্দ্র রেডিওর পাশাপাশি অবলোহিত তরঙ্গেও দেখা যায়। মহাকাশে ২০০৯ সালে নাসা’র পাঠানো ইনফ্রারেড স্পেস টেলসিস্কোপ ‘ওয়াইজ’ দিয়ে তোলা ছবিতে এই অঞ্চলে ইনফ্রারেড তরঙ্গ বিকিরণ করা একটা বস্তু পাওয়া গিয়েছিল। এই বস্তুর সাথে মিয়ারক্যাটের ছবির সম্পর্ক নিয়ে এস্ট্রোনমাররা এখনো কাজ করছেন।

এসএনআর-৯ অতি রহস্যময়। অনুভূমিক না করে এর আসল ছবি উপরে বড় করে দেয়া হয়েছে। মিয়ারক্যাট এটা সম্পর্কে নতুন কি জানতে পেরেছে তা প্রকাশিত পেপারে বলা হয়নি, কিন্তু এক্স-রে দুরবিন দিয়ে তোলা আগের বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে আমরা জানি, এই এসএনআরের খোলসের মধ্যে সালফার ও সিলিকনের মতো ভারী মৌলও তাদের ইলেক্ট্রন ধরে রাখতে পারে না। কেন তা আজো জানা যায়নি। মিয়ারক্যাটের ছবিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হচ্ছে এই এসএনআর থেকে ছুটে বের হতে থাকা এক পলাতক পালসার (নিচে বাম দিকে)। হয়ত যেই বিস্ফোরণ থেকে এসএনআরটার জন্ম সেই বিস্ফোরণের পর তৈরি হওয়া পালসারটাই খোলস ফুঁড়ে ছুটে চলেছে এন্টার্কটিকার দিশাহারা পেঙ্গুইনের মতো। এই পালসারকে অবশ্য পেঙ্গুইন না বলে বিজ্ঞানীরা ডাকছেন ‘ইঁদুর’। ইঁদুরের খুব কাছেই এসএনআর-৯-এর উপরে ধনুকের মতো ঝুলে আছে এক বিরাট ফিলামেন্ট, বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘সাপ’ (ছবিতে ৬)। এসএনআর রেখে সর্পিল ফিলামেন্টদের সাথে পরিচিত হওয়ার তাই এখনি সময়।

চৌম্বক ফিলামেন্ট

প্রথম দুই ছবিতে সুতার মতো বা সাপের মতো সরু বঙ্কিম রেখার সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। কিন্তু কি এরা? প্রায় ৩৫ বছর আগে আকাশগঙ্গার গর্ভে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল এই সব সাপ, কিন্তু এদের উৎপত্তির কারণ আজো নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। রেডিও তরঙ্গে কেন আমরা এদের দেখতে পাচ্ছি সেটা অবশ্য পরিষ্কার। দ্বিতীয় ছবিতে প্রায় প্রতিটা ফিলামেন্ট সাদা থেকে কমলা রঙের মাঝামাঝি, অর্থাৎ তাদের স্পেক্ট্রাল ইন্ডেক্স নেগেটিভ, যার অর্থ এরা রেডিও বিকিরণ নিঃসরণ করছে চুম্বকক্ষেত্ররেখার চতুর্দিকে আলোর কাছাকাছি বেগে ঘুরতে থাকা ইলেক্ট্রনের দৌলতে। আরেকটু খোলাসা করা যাক। প্রতিটা ফিলামেন্টের দৈর্ঘ বরাবর আছে ম্যাগ্নেটিক ফিল্ড লাইন। এই সব লাইনের চারদিকে সর্পিলাকারে আলোর কাছাকাছি বেগে ঘুরছে অজস্র ফ্রি ইলেক্ট্রন। ঘূর্ণায়মান ত্বরিত ইলেক্ট্রন থেকেই বের হচ্ছে রেডিও তরঙ্গ। এটা না হয় বুঝা গেল। কিন্তু এত লম্বা চুম্বকক্ষেত্ররেখা কিভাবে তৈরি হল আর ইলেক্ট্রন এত বেগ কোত্থেকে পেল সেই প্রশ্নের উত্তর অজানা। এই সব উত্তর খোঁজা নিয়ে মাস্টার্স বা পিএইচডি থিসিস করে যাচ্ছেন এস্ট্রোনমি ও এস্ট্রোফিজিক্সের অনেক রিসার্চ স্টুডেন্ট।

তবে এস্ট্রোনমাররা শুধু কারণ জানতেই আগ্রহী না, মহাবিশ্বের নিছক মানচিত্র তৈরিতেও তাদের আগ্রহ যেকোনো কার্টোগ্রাফারকে হার মানাবে। তারা দেখেছেন আর মেপেছেন সব ফিলামেন্ট। মিয়ারক্যাট এবার এত ফিলামেন্ট আবিষ্কার করছে যে এই প্রথম গ্যালাক্সির মধ্যপ্রদেশের ফিলামেন্ট পপুলেশনের উপর একটা পারিসাংখ্যিক জরিপ চালানো সম্ভব হবে। দ্বিতীয় ছবিতে বিশেষভাবে চিহ্নিত আছে আর্ক ফিলামেন্ট (৪), হার্প (৫) ও সাপ (৬)। গোলকাকার আর্কের সাথে যুক্ত ফিলামেন্টটা সবচেয়ে লম্বা, দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫০ আলোকবর্ষ (লাইটইয়ার)। দূরত্বের একটা ধারণা পাওয়ার জন্য মনে রাখতে হবে, প্রথম দুই ছবির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কৌণিক দূরত্ব আনুমানিক ২ ডিগ্রি, অর্থাৎ চাঁদ বা সূর্যের চার গুণ, আর রৈখিক দূরত্ব প্রায় ১৪০০ লাইটইয়ার। অর্থাৎ এই দুই ছবিতে যতটুক অঞ্চল দেখানো হয়েছে তা পার হতে আলোরও ১৪০০ বছর লাগবে। তুলনার জন্য বলা দরকার, আমাদের সৌরজগৎ পার হতে আলোর ১ দিনও লাগে না। শুধু আর্ক ফিলামেন্ট না, সাপ এবং স্যাজিটারিয়াস-সি-এর (দ্বিতীয় ছবিতে ৩) কাছে অবস্থিত ফিলামেন্টও মিয়ারক্যাটের ছবিতে আগের চেয়ে অনেক লম্বা হিসাবে ধরা দিয়েছে। আগের দুরবিনগুলার সেন্সিটিভিটি (গ্রহণক্ষমতা) বেশি ছিল না বলেই তারা ফিলামেন্টের তুলনামূলক কম উজ্জ্বল অংশগুলা দেখতে পারেনি। মিয়ারক্যাট সবচেয়ে বেশি ফিলামেন্ট দেখেছে স্যাজিটারিয়াস এ (১) ও সি (৩) এর মাঝখানে, যেখানে হার্পেরও (৫) অবস্থান।

আর্কের উপরে ও নিচে দুইটা বুদ্বুদের মতো কাঠামোকে বাইপোলার রেডিও বাবল হয়, এদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় চৌদ্দশ’ লাইটইয়ার বলে ছবিতে দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে উপরে-নিচে প্রবাহিত গ্যাস কেন্দ্র থেকে প্রায় ৭০০ লাইটইয়ার উপরে আর নিচে দুই বাবল তৈরি করেছে। আমাদের গ্যালাক্সিকেন্দ্রের ব্ল্যাকহোল সক্রিয় না, কিন্তু তার পরও তার আশপাশ থেকে ছুটছে গ্যাসের ফোয়ারা। মিয়ারক্যাট বলছে, কেন্দ্রের সাথে সংযুক্ত এই বাবলের সাথে আর্ক এবং অন্যান্য ফিলামেন্টের গভীর সংযোগ আছে; তারা একই প্রক্রিয়ার ফলাফল। অনেকে মনে করছেন, কেন্দ্র থেকে প্রায় আলোর বেগে ছুটে চলা ইলেক্ট্রনদের সাথে বিভিন্ন তারা থেকে তৈরি ঝড়ের মিথস্ক্রিয়ায় ফিলামেন্টগুলা তৈরি হয়েছে। কেন্দ্রই যেহেতু সব সৃষ্টির চালিকাশক্তি সেহেতু আমরা এই বার কেন্দ্রের আরেকটু কাছে ঘেঁষি।

আণবিক মেঘ

পৃথিবীর পিঠে যেমন অনেকগুলো দেশ তেমনি আমাদের-দেখা আকাশগোলকের পেটকে আমরা হিসাবের সুবিধার্থে ৮৮টা কনস্টেলেশন বা তারামণ্ডলে ভাগ করেছি। আমাকে যেমন বাংলাদেশী বলা হয় তেমনি আকাশের যে বস্তু যে দেশের মধ্যে পড়ে তার নামে সেই দেশের তকমা লাগানো হয়। আকাশগঙ্গার কেন্দ্র যে-কনস্টেলেশনের মধ্যে পড়ে তার নাম স্যাজিটারিয়াস (ধনু রাশি)। তাই কেন্দ্রের আশপাশের অনেক বস্তুর নামের আগে এই দেশের নাম পাওয়া যায়। ব্ল্যাকহোলের কাছে এখনি না গিয়ে আমরা আগে স্যাজিটারিয়াস-বি-এর (ছবিতে ২) সাথে পরিচিত হব। কেন্দ্র থেকে প্রায় ৪০০ লাইটইয়ার দূরে তারা তৈরির এক কারখানার নাম স্যাজিটারিয়াস বি২ যা আসলে বিরাট এক আণবিক মেঘ। তার কাছেই আয়নিত হাইড্রোজেনের এবড়োখেবড়ো এলাকটার নাম স্যাজিটারিয়াস বি১। দুই অঞ্চলকে একসাথে বলা হয় স্যাজিটারিয়াস বি কমপ্লেক্স। প্রথম দুই ছবিতে বি২ বাম দিকে, বি১ ডান দিকে। দুয়ের মধ্যে সম্ভবত সংযোগ আছে। এককালে বি১-ও তারা বানাতে পারত, কিন্তু কাঁচামাল শেষ হয়ে যাওয়ায় আজ সে বন্ধ্যা।

স্যাজিটারিয়াস-বি২ প্রায় ১৫০ লাইটইয়ার বড়। আরো জুম করলে তার ভিতরে অনেক ছোটো ছোটো অঞ্চল দেখা যায় যেখানে নতুন তারা তৈরি হচ্ছে। এগুলোকে আমরা তারাকেন্দ্র বলতে পারি। প্রতিটা তারাকেন্দ্রের চতুর্দিকে মিয়ারক্যাট দেখেছে আয়নিত হাইড্রোজেনের বাবল। তারা থেকে বের হওয়া অতিবেগুনি রশ্মি হাইড্রোজেনের অন্দর থেকে ইলেক্ট্রন খসিয়ে তাকে পুরাপুরি আয়নিত করে ফেলতে পারে। তবে মিয়ারক্যাটের ছবিতে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হল বি২-এর স্পেক্ট্রাল ইন্ডেক্স। দ্বিতীয় ছবির দিকে একবার তাকালেই বোঝা যায় বি১-বি২ কমপ্লেক্স অন্যান্য অনেক এলাকার তুলনায় বেশি সাদা-সবুজ। অর্থাৎ এখানে ইন্ডেক্সের মান শূন্যের কাছাকাছি, এখানকার রেডিও বিকিরণের উজ্জ্বলতা কম্পাঙ্কের সাথে খুব একটা পাল্টায় না। তার মানে এখানে রেডিও বিকিরণ তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মিশ্রণে এবং কোনো একটা তড়িচ্চুম্বক প্রক্রিয়ার ঘাড়ে সব চাপিয়ে দেয়া সম্ভব না। যাহোক, আর দেরি না করে আমরা ৪০০ লাইটইয়ার পাড়ি দিয়ে চলে যাই কৃষ্ণবিবরের দোরগোড়ায়।

আকাশগঙ্গার অন্তর

অন্তর্দশনই যেহেতু মূল লক্ষ্য সেহেতু আকাশগঙ্গার অন্তর্ভাগের কথা দিয়েই আলোচনা শেষ করব। তবে কেন্দ্রের কথা বলতে গেলেই তার গা-ঘেঁষা সেই একরোখা আর্কের কথা এসে পড়ে। নিচের ছবিতে কেন্দ্র, আর্ক এবং আর্কের ফিলামেন্ট একসাথে দেখানো হচ্ছে আবারো আসল রূপে, অনুভূমিক না করে।

সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশটাই কেন্দ্র। তার উপরে প্রায় ১০০ লাইটিয়ার আকারের বিশাল গোলকটার নাম আর্ক বাবল (ছবি-২-এ ৪); এর সাথে আগে উল্লিখিত অনেক দূরের বাইপোলার বাবল গুলিয়ে ফেলা যাবে না। আর্ক বাবলের প্রায় মাঝখান দিয়ে ছুটে গেছে আর্ক ফিলামেন্ট যা, আমরা আগেই জেনেছি, মিয়ারক্যাটের দেখা সবচেয়ে লম্বা ফিলামেন্ট। ধারণা করা হয় অনেক তারার বিস্ফোরণ অর্থাৎ সুপারনোভা ধীরে ধীরে আর্ক বাবল তৈরি করেছে। বাবলের ভিতরে অনেক নবীন তারাগুচ্ছ আছে। এর মধ্যে কুইন্টাপ্লেট গুচ্ছের আশপাশে মিয়ারক্যাট বেশ কিছু ফিচার প্রথমবারের মতো পর্যবেক্ষণ করেছে। গুচ্ছ থেকে বের হওয়া ফোটন দ্বারা আয়নিত হাইড্রোজেনের কাস্তের মতো একটা অঞ্চল পাওয়া গেছে, দেখা গেছে গ্যাসের পিলার। হাবল দুরবিনের তোলা নেবুলার যেসব ছবি ফিল্মমেকার টেরেন্স ম্যালিকের কল্যাণে আধ্যাত্মিক মূল্য অর্জন করেছিল সেই ধরনের ছবি যে রেডিও দুরবিন দিয়েও তোলা সম্ভব তা মিয়ারক্যাট এবার প্রমাণ করেছে। বাবলের ভিতর দেখতে হার্পের মতো একটা নতুন ফিলামেন্টও পাওয়া গেছে।

আমরা এখনো প্রায় দুইশ লাইটইয়ার দূরে আছি কেন্দ্র থেকে। আমাদের নিজস্ব সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের কাছে যেতে হলে দেখতে হবে একেবারে কেন্দ্রের ১০০ লাইটইয়ার অঞ্চল। এই এলাকার নাম স্যাজিটারিয়াস-এ কমপ্লেক্স যেখানে তিনটা উজ্জ্বল রেডিও উৎস পাওয়া যায়। মাঝখানে গ্যাসের আড়ালে লুকানো অতিভারী কৃষ্ণবিবরের নাম স্যাজিটারিয়াস-এ*, তার পশ্চিমে আছে একটা মিনিস্পাইরাল, সর্পিলাকারে বিন্যস্ত গ্যাস, আর পূর্বে আছে একটা এসএনআর। মিনিস্পাইরালটা কৃষ্ণবিবরের চারদিকে ঘুরছে। মিয়ারক্যাটের তোলা ছবিতে তার সর্পিল আকৃতি স্পষ্ট দেখা গেছে। তবে আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে স্পেক্ট্রাল ইন্ডেক্স। তার ইন্ডেক্স পজিটিভ, অর্থাৎ কম্পাঙ্কের সাথে তার উজ্জ্বলতা বাড়ে, এবং তার বিকিরণের উৎস আয়নিত গ্যাস। ব্ল্যাকহোল এই মিনিস্পাইরালের গ্যাস ধীরে ধীরে খাচ্ছে, কেন্দ্রের ৬ লাইটইয়ারের মধ্যে আসার সাথে-সাথেই গ্যাস আয়নিত হয়ে যায়, অর্থাৎ ইলেক্ট্রন হারায়। কেন্দ্রের ১০০ লাইটইয়ারের মধ্যে থাকা এই স্পাইরালের প্রবাহের সাথে ৭০০ লাইটইয়ার দূরের সেই দুই বাবল বরাবর ছুটে চলা গ্যাসেরও সম্পর্ক থাকতে পারে।

নতুন ছবি ও বর্ণালি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা কেন্দ্রীয় অঞ্চলেও অনেক নতুন ফিলামেন্ট আবিষ্কার করেছেন। তবে দূরের ফিলামেন্টের সাথে এদের পার্থক্য হচ্ছে, এরা দূরের ফিলামেন্টদের মতো গ্যালাক্সির তল থেকে প্রধানত উপরে বা নিচে যায় না, এরা গ্যালাক্সিতলের সাথে উল্লম্ব না। কেন্দ্রীয় ফিলামেন্টগুলো বিচিত্র, একেকটা যায় একেক দিকে। এর থেকে অনুমান করা যায় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে চুম্বকক্ষেত্র অনেক বেশি জটিল। আমাদের আপন ব্ল্যাকহোলের যত কাছে যাওয়া যায় ম্যাগ্নেটিক ফিল্ড ততই বিশৃঙ্খল হতে শুরু করে। হয়ত এই ঘটনার কারণ খুঁজতেও নেমে পড়েছেন পিএইচডি-র প্যাঁচে আটকে পড়া অনেক তরুণ তরুণী।

এই নতুন ছবি গ্যালাক্সির কেন্দ্র নিয়ে নতুন গবেষণার দুয়ার খুলে দিবে কি দিবে না তা বুঝতে হলে আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুদিন। দেখতে হবে এস্ট্রোনমাররা তা কিভাবে ব্যবহার করছেন। কিন্তু সন্দেহ নাই এই ছবি থেকে জন্ম নিবে বা এখনি নিচ্ছে অনেক নতুন মাস্টার্স ও পিএইচডি। ইতিমধ্যেই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এই ধরনের একটা ছবি তোলার পিছনে অনেকে একসাথে কাজ করেন। সবচেয়ে বড় অবদান সাউথ আফ্রিকার মতো ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দেশেও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য স্বর্গ রচনা করা প্রতিষ্ঠান সাউথ আফ্রিকান রেডিও এস্ট্রোনমি অব্জার্ভেটরি (সারাও)। এই সংগঠন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানযন্ত্র স্কয়ার কিলোমিটার অ্যারে-র (এসকেএ) আফ্রিকান অর্ধেকটা নির্মাণে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই রেডিও দুরবিনের বাকি অর্ধেকটা গড়ে উঠছে অস্ট্রেলিয়াতে।

উপরের ছবিতে দেখানো মিয়ারক্যাটের ৬৪টা ডিশের চারদিকে আরো ডিশ যোগ করে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত মোট ১৯৭ ডিশ নিয়ে তৈরি হবে এসকেএ’র আফ্রিকান অংশ। এসকেএ-আফ্রিকা প্রতি সেকেন্ডে ৮ টেরাবাইট ডেটা পাঠাবে কম্পিউটারে। তার রেজলুশন (ভাজনক্ষমতা) ও সেন্সিটিভিটি (গ্রহণক্ষমতা) হবে বর্তমানে একই ধরনের সবচেয়ে ভালো দুরবিনের চেয়ে চার-পাঁচ গুণ ভালো। সে সারা আকাশ সার্ভে করতে পারবে ষাট গুণ দ্রুত বেগে। মিয়ারক্যাটই যদি গ্যালাক্সিকেন্দ্রের গুণ্ঠন এভাবে খসিয়ে দেয় তাহলে ভবিষ্যৎ এসকেএ কি করবে তা চিন্তা করে টার্নারের পেইন্টিঙের দিকে মনে-মনে আবার তাকাই, তবে এবার অপলক অটলতায়।

সাউথ আফ্রিকা ও বাকি পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানী রাত দিন খেটেছেন গ্যালাক্সিকেন্দ্রের এই ছবি নির্মাণে। তাদের তুলনায় এখানে আমার অবদান পরমশূন্যের কাছাকাছি, মহাশূন্যের পটবিকিরণ (সিএমবি) পরমশূন্যের যত উপরে তার চেয়েও অনেক কম। মিয়ারক্যাট দুরবিনের গ্রহণক্ষমতা মেপেছিলেন সারাও-এর এক বিজ্ঞানী। তার মাপা গ্রহণক্ষমতার একটা হালকাপাতলা মডেল তৈরি করে আমি সব এস্ট্রোনমার ব্যবহার করতে পারেন এমনভাবে প্রকাশ করেছিলাম রয়েল এস্ট্রোনমিকেল সোসাইটি’র জার্নালে। গ্যালাক্সিকেন্দ্রের ছবি নির্মাণে সেই মডেল ব্যবহার করা হয়েছে বলেই অনেকের মতো আমিও আছি এই পেপারের সুপারম্যাসিভ লেখকতালিকায়। অতি সামান্য অবদান হলেও এটা আমার জন্য অনুপ্রেরণা।